ঢাকামঙ্গলবার , ১৬ জানুয়ারি ২০২৪
  • অন্যান্য

আয়ানের মৃত্যু এবং এনেস্থেসিয়া

ডা. সুশান্ত বড়ুুয়া
জানুয়ারি ১৬, ২০২৪ ৩:৫৬ অপরাহ্ণ । ৬৭০ জন

যেকোনো মৃত্যুই ভীষণ বেদনার। আয়ান এর মৃত্যু ও ঠিক তাই। কিন্তু মৃত্যু ঠিক কি কারণে ঘটেছে সেটা না জেনে, না ঘেটে, চিকিৎসক কিংবা জেনারেল এনেস্থেসিয়া কে দায়ী করা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক।

এনেস্থেসিয়া সম্পর্কে ধারণা নেই এমন লোকজন, বিশেষ করে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম কী করে বলেন, সামান্য খৎনা করাতে কেন এত বড় এনেস্থিসিয়া দিতে গেল? যারা এই প্রশ্ন তুলছেন তাদের তো কোন বেসিক ধারণা নেই। থাকলে তো তুলনামূলক নিরাপদ, জেনারেল এনেস্থিসিয়া নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে মনগড়া ধারণা বিতরণ করতে নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে এসে সর্ব রোগ বিশেষজ্ঞের মত বিভ্রান্তি ছড়াতো না।

View লাগবে view

আসলে এই মুনাফা সংগ্রহের যুগে সবই পণ্য, মানুষের করুন আবেগও পণ্য। ভিউ লাগবে ভিউ। কেউ দূর্ঘটনায় পড়লে তাকে তাৎক্ষণিক উদ্ধারে মনোযোগ নেই, মোবাইল বা পার্সোনাল ক্যামেরা তাক করে পণ্য সংগ্রহ করায় ব্যস্ত। ভিউ লাগবে ভিউ …

যাই হোক, ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনেক এনেস্থেসিয়োলজিস্ট মতামত রেখেছেন। ওসব মতামত দেখলে সকলেই পরিষ্কার হবেন যে তিন পদ্ধতি – জেনারেল, পার্সিয়াল, লোকাল- এর মধ্যে তুলনামূলক নিরাপদ হলো জেনারেল এনেস্থিসিয়া। তবে জেনারেল এনেস্থিসিয়া কিংবা যেকোনো পদ্ধতি প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই কিছু ফিটনেস পরীক্ষা বা প্রি চেকআপ করে নিতে হয়। এটার উপর এবং রোগ ও রোগীর ধরণ বুঝে এনেস্থেসিয়ার পদ্ধতি বাছাই করা হয়।

কিন্তু সমস্ত প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ সত্বেও যেকোনো চিকিৎসায় মৃত্যুর একটা নির্দিষ্ট হার রয়েছে। যেমন কয়েক লাখে দু’একজনের জ্ঞান না ও ফিরতে পারে। সেটা খুবই খুবই রেয়ার (Rare)। তাই বলে লাখ লাখ জীবন বাঁচাবার অপারেশন বন্ধ করে দিতে হবে? অনেকটা বাস দূর্ঘটনা বা বিমান দূর্ঘটনার মতো। আমরা কি বিমানে চড়া বন্ধ করে দেই? না।

এসব নলেজ না জেনে বা আইডিয়া না রেখেই কোন চিকিৎসককে দায়ী করা সম্পূর্ণ গর্হিত কাজ। কারণ এই মৃত্যু কি এনেস্থিসিয়ার কারণে, নাকি অপারেটর এর অবহেলায়, নাকি পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার এর অভাবে সেটি নিশ্চিত না হয়ে কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয় কেবল জেনারেল এনেস্থিসিয়া দেয়াতে আয়ানের মৃত্যু। এমনও তো হতে পারে কোন একটা এনেস্থেটিক এজেন্ট বা ড্রাগ টলারেট করেনি বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এসব না জেনে কোন চিকিৎসার প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক। কেবল আবেগের বশে ও এটা না করা উচিত। আর সেটি যদি সংবাদমাধ্যম এবং তার কর্মীরা করেন সেটা আরো দুঃখজনক। এতে জনমনে আরও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

এর দায় কি সংবাদ মাধ্যম নেবে?

কারণ আতংক কেবল জনমনে নয়, চিকিৎসকরাও আতংকিত বোধ করেন,বিপন্ন বোধ করেন। এটি চলতে থাকলে এরকম একটা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় লোক আসতে নিরুৎসাহিত হবে। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হবে, জরুরী রোগীর দায়িত্ব নিতে কোন চিকিৎসক সাহস করবে না। এতে জরুরী চিকিৎসার সুযোগ সংকুচিত হবে।

মনে রাখতে হবে চিকিৎসা একটি ঝুঁকি পূর্ণ পেশা, স্বয়ং চিকিৎসকের জীবন ও বিপন্ন হয়ে যায়। জীবনঘাতী জীবাণু সংক্রমিত কোন রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক নিজেই মৃত্যুর মুখে পতিত হন। এ রকম একটা পেশায় দূর্ঘটনা ঘটলে আপাদমস্তক না জেনে সমালোচনা করা অপরিপক্ক কাজ।

যেটা যে বিষয় সে বিষয়টা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অন্য যেকোন নিরপেক্ষ ব্যক্তির কাছে জেনে অন্তত মন্তব্য করুন। যাচাই বাছাই ছাড়া কেবল পাবলিক পারসেপশনের উপর নির্ভর করা কোন সচেতন ব্যক্তির উচিত নয়। এমনকি জেনারেল এনেস্থিসিয়ায় মৃত্যু হলেও চিকিৎসক দায়ী নয়,ওটা এনেস্থেটিক হ্যাজার্ড। আপনারা যে মাঝে মধ্যে এন্টিবায়োটিক বা যেকোন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত মৃত্যুর কথা শোনেন – এই হ্যাজার্ড ও সেরকম। তাই বলে কি আপনি আমি ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছি? না। ঔষধ আমাদের বেঁচে থাকার নিত্য সঙ্গী। এই এনেস্থিসিয়া ও অপারেশন করার নিত্য সঙ্গী। আর এই অপারেশন ই হাজারো জীবন বাঁচিয়ে দিচ্ছে সারাবছর।

কেবল অবহেলাজনিত মৃত্যুই শাস্তি যোগ্য। আর এই শাস্তি জেল হাজত নয়, জরিমানা কিংবা লাইসেন্স বাতিল। এই বিধান বিশ্বজনীন।

আপনারা অনেকেই জানেন না খৎনায় জেনারেল এনেস্থিসিয়া তুলনামূলক নিরাপদ। আয়ানের দুঃখজনক মৃত্যুর মাধ্যমে মেডিকেল সাইন্স পাল্টে দিতে যাবেন না।

ইউনাইটেড হাসপাতাল প্রসঙ্গ

এদের লাইসেন্স আছে কি নেই সেটি চাকুরিরত বা ওখানে প্র্যাক্টিসরত চিকিৎসকের দায় নয়। এটি সম্পূর্ণ হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিষয়। এ ক্ষেত্রে ও চিকিৎসা এবং চিকিৎসককে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। করলে ঐ যে বললাম, জরুরী চিকিৎসার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যেতে বাধ্য।

কারণ ব্যক্তি চিকিৎসক একটা খারাপ কেইজ হেন্ডেল করে অপদস্ত কিংবা বদনামের ভাগী হতে ঝুঁকি নেবেন না। এভাবে আস্তে আস্তে জরুরী চিকিৎসার সুযোগ সংকুচিত হবে। আমরা যেকোনো অননুমোদিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে।

আর ইউনাইটেড গ্রুপ তো চট্টগ্রামে সিআরবি লিজ নিয়ে হসপিটাল স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। এই গ্রুপের যেনতেন প্রকারে বাণিজ্য করার পথ বন্ধ করা হউক এবং গ্রুপের সাথে জড়িত আমলাসহ সকলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া হউক। আশা করি, বাংলাদেশের চিকিৎসক-রোগীর (Doctor-patient) আন্ত সম্পর্ক উন্নয়নে সর্বমহল দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। অবশ্যই চিকিৎসকরা আরো রোগীবান্ধব হবেন এবং কাউন্সেলিং এর উপর জোর দেবেন।

লেখক : ডা:সুশান্ত বড়ুয়া, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক।