বাংলাদেশে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে (এমআরপি)’ যেহেতু সব ধরনের পণ্য বিক্রি হয় সেহেতু সিগারেটও এমআরপিতে বিক্রি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি না করে মোড়কে উল্লিখিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। পরিস্থিতি এমন, খুচরা বিক্রেতাকে এমআরপি মূল্যে কোম্পানির কাছ থেকেই সিগারেট কিনতে হয়। যার ফলে বাধ্য হয়েই খুচরা বিক্রেতা লাভের আশায় ভোক্তার কাছে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করছেন। ফলে ভোক্তা থেকে নেয়া বাড়তি এ টাকার কোনো রাজস্ব পায় না সরকার। এভাবে প্রতিবছর সরকারের প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে সিগারেট কোম্পানিগুলো।
২০২১-২২ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) এর গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি প্যাকেট সিগারেটে ১৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিইআরের গবেষণা এবং গবেষণাটি নিয়ে একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত বিশেষ প্রতিনিধি সুশান্ত সিনহার একটি প্রতিবেদন আমলে নেয় এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করে ঘটনার সত্যতা পায় তারা।
তামাক কোম্পানির কারসাজি বন্ধ করতে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিধান/প্রজ্ঞাপনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনয়নের প্রস্তাব’করা হয়েছে। এই প্রস্তাব অনুসারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক জারি করা এসআরও তে (এসআরও নং-১৪০ ও ১৪১) ‘প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য সুস্পষ্ট লক্ষণীয় ও অনপনীয়ভাবে মুদ্রিত’ থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সেখানে (এসআরও নং-১৪০) বলা হয়েছে, “সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের অধিক মূল্যে কোন পর্যায়েই সিগারেট বিক্রয় করা যাইবে না”।
কিন্তু এনবিআর গত জুন মাসে নির্দেশনা দিলেও কোম্পানিগুলো সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পুরনো দামে সিগারেট বিক্রি করেছে পাশাপাশি কোম্পানিগুলো প্যাকেটের গায়ে খুচরা মূল্য লিখে সিগারেট বাজারজাত করেছে। যা আইন বহির্ভূত। কিন্তু তারপরও তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
এমআরপিতে সিগারেট বিক্রি না হওয়ার অন্যতম কারণ তামাক কোম্পানির খুচরা বিক্রেতাদের বাস্তবসম্মত ‘ট্রেড মার্জিন’ বা লাভ না দেয়া। আসলে ট্রেড মার্জিনের পুরো টাকাটা কোম্পানি রেখে দেয়া। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের প্যাকেটের গায়ের দামের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করতে হয়। আর নিকোটিন যেহেতু মানুষকে আসক্তি করে রাখে, তাই বাদ্ধ হয়ে ভোক্তাদের বেশি দামে কিনতে হয়। ইতোমধ্যে বাস্তবসম্মত ট্রেড মার্জিন ঘোষণা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএটিবিসহ অন্যান্য তামাক কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে এলটিইউ। ফলে বিষয়টি এনবিআরের নজরে আসায় দ্রুতই এ বিষয়ে ফলাফল দেখা যাবে বলে প্রত্যাশা করতে পারি।
যদি তামাক কোম্পানির হাত অত্যন্ত শক্তিশালী, তারপরও আমরা এ বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করছি। কারণ বর্তমানে দেশে যে অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে তাতে বিশাল এ অর্থ সরকারের ভীষণ জরুরি।
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে সরকার বড় অংকের রাজস্ব ঘাটতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বিগত ছয় মাসের রাজস্ব আদায়ের চলমান ধারা পর্যবেক্ষণে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে এ অর্থবছর শেষে ৮২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। কারণ দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট, বাজেট বাস্তবায়নে নিম্ন ও শ্লথ গতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নগামী এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স নিচের দিকে রয়েছে।
এমতাবস্থায় সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে সিগারেট নিশ্চিত করা জরুরি। এতে সরকার কিছুটা হলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
এছাড়া তামাক সেবনের হার হ্রাস ও সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধিসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। যথা:
১. মূল্য সংযোজন কর ও সম্পুরক শুল্ক আইন ২০১২, এর ধারা ১৫ ও ধারা ৫৮ এর বিধান অনুযায়ী তামাকজাত পণ্যের উপর সুনির্দিষ্টকর আরোপ করা;
২. বিড়ি’র সঙ্গে নিম্নস্তরের সিগারেটের দামের পার্থক্য কমাতে বিড়ির দাম বৃদ্ধিসহ বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে (জর্দা ও গুল) সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে দাম বৃদ্ধি করা;
৩. সিগারেটের ব্র্যান্ডসমূহের মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে সিগারেটের মূল্যস্তর ৪টি থেকে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে ২টিতে এবং ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরের মধ্যে ১টিতে নামিয়ে আনা;
৪. কার্যকর ও সহজ তামাক কর নীতি প্রণয়নের জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করা;
৫. তামাকজাত পণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস করতে মূল্যস্ফীতি এবং আয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি করা;
৬. তামাক কোম্পানিকে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট সুবিধা প্রদান বন্ধ করা। উল্লেখ্য, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২-এর ৪৬ ধারার বিধান অনুযায়ী তামাক কোম্পানিসমূহকে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট সুবিধা প্রদান বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিধান ২০১৯ সালের সংশোধনীতে বাদ দেয়া হয়। ২০১২ সালের আইনের বিধানটি পুণঃস্থাপন করার মাধ্যমে তামাক কোম্পানিকে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট সুবিধা প্রদান বন্ধ করা প্রয়োজন;
৭. পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে তামাকপাতা রপ্তানিতে ২৫% শুল্ক পূণঃবহাল করা;
৮. সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তামাক পণ্য ও তামাকসংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপ;
৯. জর্দা-গুলসহ তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী সকল কোম্পানিকে নিবন্ধন ও করজালের আওতায় আনাসহ খোলা তামাক পাতা (সাদাপাতা) মোড়কের আওতায় এনে কর আরোপ ও আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ;
১০. করারোপ প্রক্রিয়া সহজ করতে তামাকজাত পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন (ফিল্টার/নন ফিল্টার বিড়ি, সিগারেটের মূল্যস্তর, জর্দা ও গুলের আলাদা খুচরা মূল্য প্রভৃতি) তুলে দেয়া;
১১. সকল প্রকার ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, ই-সিগারেট এবং হিটেড তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা;
১২. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের টোব্যাকো ট্যাক্স সেল-কে শক্তিশালী করা;
১৩. সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে লেখা ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি)’ অনুযায়ী ভোক্তাপর্যায়ে বিক্রয় নিশ্চিত করা।
উপরোল্লিখিত প্রস্তাবনার আলোকে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে তামাকজাত দ্রব্যে কর বাড়ানো হলে দেশের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে অপরদিকে তামাক ব্যবহারজনিত রোগ-ব্যধি ও মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এসডিজি’র স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক লক্ষ্য-৩ অর্জনে অগ্রগতি সাধিত হবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : প্রজেক্ট অফিসার, টোব্যাকো ট্যাক্স প্রজেক্ট, অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।