ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২২ আগস্ট ২০২৪
  • অন্যান্য

আজকের সর্বশেষ সবখবর

কেনো খুচরা শলাকায় সিগারেট বিক্রি বন্ধ চায় না তামাক কোম্পানি

ইব্রাহীম খলিল
আগস্ট ২২, ২০২৪ ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ । ৫২ জন

বাংলাদেশ তামাক পাতা উৎপাদনে বিশ্বে ১৪তম। কিন্তু সিগারেটের বাজারের দিক দিয়ে বিশ্বে অষ্টম! ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসায় মুনাফা এবং নিজেদের বাজার ধরে কতোটা বেপরোয়া।  সিগারেটের বাজার ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।  বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, রাজস্ব ফাঁকি ও নিজেদের প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি নিষিদ্ধ থাকলেও এর সবগুলোই তারা করছে নানা কূটকৌশলে।

তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে।  এর কারণ খুচরা শলাকায় সিগারেট বিক্রি এবং নির্ধারিত মূলের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হওয়ায় সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে।  পাশপাশি তরুণদের মধ্যেও সিগারেট গ্রহণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কিন্তু সিগারেট কোম্পানি নানা কূটকৌশল ও অজুহাতে এর কোনোটাই বাস্তবায়ন চায় না। তাদের এ না চাওয়ার পিছনে যুক্তি কী? আসলে তামাক কোম্পানির ভাষ্য, সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ হলে সরকারের নাকি রাজস্ব কমে যাবে।  অন্যদিকে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রির সঙ্গে নাকি তামাক কোম্পানি কোনোভাবেই যুক্ত নয়! কিন্তু বাস্তবতা কি সেটা বলে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত “তামাকজাত দ্রব্যের (সিগারেট) খুচরা বিক্রয়মূল্যে জাতীয় বাজেটে মূল্য ও কর পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণে একটি সমীক্ষা” শীর্ষক একটি গবেষণায় আমরা দেখেছি দেশে সকল পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় ‍মূল্যে বিক্রি হলেও সিগারেট ও বিড়ি হয় না। বরং সিগারেট কোম্পানিগুলোই খুচরা মূল্যে বিক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। আর বিক্রেতারা তার চেয়ে বেশি মুল্যে ক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। অতিরিক্ত বিক্রয় মূল্যের ওপর কর আদায় সম্ভব হলে প্রতি অর্থবছরেই সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় বেশি হতো বলেও এ গবেষণায় উঠে এসেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, তামাক কোম্পানিগুলো খুচরা শলাকায় সিগারেট বিক্রি বন্ধ হোক সেটা কেনো চায় না? আসলে এর পিছনেও রাজস্ব ফাঁকির জন্য তাদের রয়েছে আরেক কূটকৌশল। চলতি অর্থবছরের অতীতের ন্যায় সিগারেটের চারটি স্তরে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর মধ্যে অতি উচ্চস্তরের ১০ শলাকা সিগারেট প্যাকেটের খুচরা মূল্য ১৬০ টাকা, উচ্চস্তর ১২০ টাকা, মধ্যমস্তর ৭০ টাকা ও নিম্নস্তর ৫০ টাকা।  সে অনুযায়ী অতি উচ্চস্তরের প্রতি শলাকার মূল্য ১৬ টাকা, উচ্চস্তরের প্রতি শলাকা ১২ টাকা, মধ্যমস্তর প্রতি শলাকা ৭ টাকা ও নিম্নস্তরের প্রতি শলাকা ৫ টাকা।

কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অতি উচ্চস্তরের প্রতি শলাকার মূল্য ১৮-২০ টাকা, উচ্চস্তরের প্রতি শলাকা ১৩ টাকা, মধ্যমস্তর প্রতি শলাকা ৮-১০ টাকা ও নিম্নস্তরের প্রতি শলাকা ৬-৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।  এভাবে বেশি দামে বিক্রির জন্য কোম্পানি থেকে বিক্রির বিজ্ঞাপনও বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।  ফলে ক্ষেত্র বিশেষে ১ টাকা নয়, দেড় থেকে ২ টাকাও বেশি নেয়া হচ্ছে।  অন্যদিকে প্যাকেট প্রতি নেয়া হয় ১৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেশি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্পষ্ট করে দিয়েছে সিগারেট সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই বিক্রি করতে হবে। কিন্তু বাজারে সেটার বাস্তবায়ন নেই।  এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে এনবিআর দাম নির্ধারণ করে দিবে কিন্তু বাস্তবায়নের দায় তাদের নয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে এটার বাস্তবায়ন করবে কে? স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দিকে। তারা নিজেরাও সেটা স্বীকারও করে। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের যথাযথ কোনো পদক্ষপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর গবেষণায় দেখা গেছে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার পিছনে তামাক কোম্পানিই সরাসরি জড়িত! কারণ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করার সময় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী ও মধ্যসত্বভোগীর মুনাফা বাদ দিয়ে সেটা বাজারে ছাড়ে।  ফলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই সেই পণ্যটি ভোক্তারা কিনতে পারে। কিন্তু সিগারেটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই তামাক কোম্পানিগুলো বাজারে ছাড়ে এবং পাইকারী বিক্রেতাদেরই খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।  ফলে খুচরা বিক্রেতারা আরও লাভে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করতে বাধ্য করছে তামাক কোম্পানি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হলে মানুষ কেনে কোনো? আসলে তারা মানুষের নিকোটিনে আসক্তি নিয়ে ব্যবসা করে। তারা জানে, মূল্য বেশি নিলেও নিকোটিনে আসক্ত এসব মানুষ ঠিকই সিগারেট কিনবে। কারণ তাদের এটা ছাড়া আর উপায়ও নেই।!তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটে সাত হাজারের বেশি কেমিক্যাল মেশানো হয়। ভয়াবহ এসব কেমিক্যালে আসক্ত হয়ে মানুষ হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে।

তবে আশার কথা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর গবেষণাটি নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ ও তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর অভিযোগের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে এ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে মাঠ পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন কবে এবং কতোটুকু হবে সেটার জন্যই অপেক্ষা করতে হবে।

অন্যদিকে সিগারেটের মূল্য নির্ধারণ, বহুস্তরভিত্তিক তামাক কর কাঠামো, তামাকে সুনির্দিষ্ট করারোপ না করাসহ সিগারেটে রাজস্ব ফাঁকির বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথযথ পদক্ষেপের অভাব রয়েছে বলেই হয়।  সেটা নাহলে বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার পরও তারা পদক্ষেপ নেয়নি কেনো? আমরা মনে দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও রাজস্ব বৃদ্ধিতে বিষয়টি বিবেচনায় নিবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

লেখক : প্রজেক্ট অফিসার, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)