বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরবর্তী পুনরুদ্ধারের পর উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা এবং তরুণ সমাজ, বিশেষ করে নারী ও শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাকরির সীমিত সুযোগকে প্রভাবিত করছে বলে এক প্রতিবেদন জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি মঙ্গলবার(১৫ অক্টোবর) প্রকাশিত তার দ্বিবার্ষিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ কথা জানায়।
বাংলাদেশ ও ভুটানে বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আলোকে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ ও নারীরা তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে চাকরি পেতে অসুবিধায় পড়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু বারবার বাংলাদেশ প্রতিকূলতার মধ্যেও অসাধারণ সহনশীলতা ও দৃঢ়তা দেখিয়েছে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, অর্থনৈতিক ও আর্থিক শাসন জোরদার করতে জরুরি ও সাহসী সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসতে পারবে এবং এর মাধ্যমে যুবসমাজের জন্য লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’
সর্বশেষ বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে তুলে ধরা হয়েছে যে বৈশ্বিক এবং দেশীয় কারণগুলো দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সামষ্টিক আর্থিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। মূলত দুর্বল ভোগ ও রপ্তানির কারণে ২০২৪-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৬ অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আগে বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের কার্যক্রম কমে ২০২৫ অর্থবছরে তা ৪ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশেও আয় বৈষম্য বাড়ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আয় বৈষম্যের পরিমাপক বাংলাদেশের গিনি সূচক প্রায় তিন পয়েন্ট বেড়ে শূন্য দশমিক ৫০ থেকে শূন্য দশমিক ৫৩ হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেশকে একটি শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে ফিরে আসতে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় জরুরি ও সাহসী সংস্কারের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সামগ্রিক বেকারত্বের হার হ্রাস সত্ত্বেও, তরুণরা বিশেষত শহরাঞ্চলে উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ বেকারত্বের হারের মুখোমুখি হয়েছে।
শহুরে শিক্ষিত তরুণদের চাকরির প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে এবং তৈরি পোশাক খাতের মতো বড় শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টি স্থবির হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ঢাকায় আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট এই তিন বিভাগ উল্লেখযোগ্য হারে কর্মসংস্থান হারিয়েছে।
খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরে গড়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে এবং আগস্টে পরিমিত হয়েছে। এটি নিকট মেয়াদে উচ্চতর থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে সরবরাহ-দিকের সমস্যাগুলো স্থিতিশীল হলে এবং বিচক্ষণ আর্থিক ও রাজস্ব নীতি বজায় রাখলে মাঝ সময়ে এসে ধীরে ধীরে কমবে।
রাজস্ব ঘাটতি ২০২৪ অর্থবছরে জিডিপির সাড়ে ৪ শতাংশ এ প্রান্তিকভাবে সংযত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে এবং ২০২৫ অর্থবছরে সরকারের জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। উৎপাদনশীল ব্যয়ের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্র কেবল ধীরে ধীরে বাড়বে।
বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ২০২৪ অর্থবছর ৮০ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০২৩ অর্থবছরে ৮৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
আমদানি সংকোচন এবং শক্তিশালী রেমিট্যান্সের কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি ২০২৪ অর্থবছরে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। বাধাবিঘ্নের কারণে জুলাই মাসে রেমিট্যান্স কমলেও তা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও কমেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও প্রতিবেদনের সহলেখক ধ্রুব শর্মা বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং বিনিময় হারের নমনীয়তা বাড়লে ২০২৫ অর্থবছরেও বিদেশি খাতের ওপর চাপ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ ২০২৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে চলমান বিনিময় হার ব্যবস্থার দিকে একটি পদক্ষেপ হিসাবে একটি ক্রলিং পেগ বিনিময় হার সিস্টেম বাস্তবায়ন করেছে।
এর ফলে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান কমে যায়। ব্যাংকিং খাতে যখন তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এ খাতে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।