ঢাকামঙ্গলবার , ২২ অক্টোবর ২০২৪
  • অন্যান্য

তামাক পরিবেশের উপর ‘বিধ্বংসী’ প্রভাব ফেলছে

ফাহমিদা ইসলাম
অক্টোবর ২২, ২০২৪ ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ । ২৫০ জন

আমরা সকলেই জানি তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তামাকের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি অনেক সময় আড়ালেই থেকে যায় । উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে তামাক পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরনের পুরো সময়টাতে বনভুমি উজাড়, পানি দূষণ, বিষাক্ত বর্জ্য তৈরিসহ পরিবেশে নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর, তামাকের কারণে বিশ্বে ৬০০ মিলিয়ন গাছ, ২০০,০০০ হেক্টর জমি, ২২ বিলিয়ন টন পানি নষ্ট হয় এবং ৮৪ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। শুধুমাত্র কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের পরিমান এয়ারলাইন কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত কার্বন ডাই অক্সাইডের এক-পঞ্চমাংশের সমতুল্য। পৃথিবীতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যে সিগারেটের ব্যবহার সর্বাধিক। বিশ্ব জুড়ে প্রতিবছর, সাড়ে চার (৪.৫) ট্রিলিয়ন সিগারেটের বাট (উচ্ছিষ্টাংশ) ফেলা হয়। তন্মধ্যে কোটি কোটি সিগারেটের বাট বিভিন্ন জলাশয়ে পড়ে পানি দূষণ করে এবং সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষতি করে। এছাড়া , ই-সিগারেট এর বর্জ্য প্লাস্টিক, নিকোটিন সল্ট, সিসা, পারদ, লিথিয়াম- আয়ন ব্যাটারির দূষণের মাধ্যমে জীবপ্রণালীর জীবন বিপন্ন করে তুলছে।

বেশিরভাগ তামাক চাষ হয় নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে যেখানে খাদ্য উৎপাদনের জন্য পানি এবং কৃষিজমি অত্যন্ত প্রয়োজন। তামাক চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক এবং রাসায়নিক পদার্থের  কারনে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। ফলে সেইসব জমিতে অন্য শস্য চাষ করা যায়না । এতে কারনে খাদ্য শস্য চাষের জমি কমে যাচ্ছে যা খাদ্য সংকটের ঝুঁকি তৈরি করছে। তামাক চাষ পৃথিবীর ২-৩ শতাংশ বন ধ্বংসের জন্য দায়ী । এক একর জমিতে যে পরিমান তামাক উৎপন্ন হয় তা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ৫ টন কাঠ। বাংলাদেশে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে ৩০ শতাংশ বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে । দেশের পার্বত্য এলাকাগুলোতে তামাক চাষ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা বনভূমি ধ্বংস করছে। সেইসাথে এসব এলাকার পানির উৎস যেমন নদী নালা, খাল বিলের পানি দূষিত হয়ে সুপেয় পানির সংকট তৈরি হচ্ছে এবং এ উৎসের উপর নির্ভরশীল প্রাণীদের জীবনও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

তামাকের কারণে পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়। তামাক কোম্পানিকে তাদের উৎপাদিত পণ্য দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতির জন্য কখনো দায়ী করা হয় না। বরং তামাক কোম্পানি কৌশলে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করে। তারা সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) নামে নানাধরনের ‘পরিবেশবান্ধব’ কর্মসূচি যেমন বৃক্ষরোপণ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পরিচালনা করছে। এসব কাজের মাধ্যমে তারা নীতি নির্ধারক এবং জনগনের সামনে নিজেদের পরিবেশের বন্ধু হিসেবে তুলে ধরছে। অথচ তাদেরই উৎপাদিত পণ্য পরিবেশ দূষণসহ প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন এর বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ।

তামাক কোম্পানি কৌশলে নিজেদের পরিবেশেবান্ধব রুপে তুলে ধরে। মূলত এটি একটি প্রতারণার কৌশল। বাস্তবে যেখানে তাদের পণ্য এবং ব্যবসায়িক কার্যকলাপ পরিবেশকে ধ্বংস করছে, সেটি ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরনের কৌশল কোম্পানির পক্ষে মিথ্যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। এ ধরনের কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য থাকে শুধুমাত্র নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির জন্য নীতিতে প্রভাব বিস্তার করা। তাদের তথাকথিত এসব মহতি কাজের নেপথ্যের সত্যটা হল পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টি আড়াল করা। তামাক কোম্পানি পরিবেশে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করে। তামাক কোম্পানি হচ্ছে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় পরিবেশ দূষণকারী। এটি কোনভাবেই পরিবেশ বান্ধব নয়।

এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। তামাক আমাদের পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলছে। তাই এই বিষাক্ত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির বিভ্রান্তি তৈরির কুট কৌশল প্রতিহত করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রনে আন্তর্জাতিক চুক্তি FCTC স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর উপর তামাক কোম্পানির নীতিতে প্রভাব বিস্তারের অপকৌশল প্রতিহত করার বাদ্ধবাধকতা রয়েছে। পরিবেশের ক্ষতির জন্য অন্যতম দায়ী হিসেবে তামাক কোম্পানিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।  সর্বোপরি, এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

লেখক : ফাহমিদা ইসলাম, উন্নয়নকর্মী