রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারি হাসপাতালে ইউজার ফি বাতিল এবং এ পর্যন্ত আদায় করা ইউজার ফি-এর স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করাসহ ১৭ দফা দাবি জানিয়েছে ডক্টরস প্ল্যাটফর্ম ফর পিপলস হেলথ (ডিপিপিএইচ)। বুধবার (১৫ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এসব দাবি তুলে ধরা হয়।
সংগঠনটির আহ্বায়ক বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ ই মাহাবুবের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. শাকিল আখতার এবং সদস্য মুসতাক হোসেন, কাজী রকিবুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলন লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন কাজী রকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সেবা ও মেডিকেল শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলছে নানা অনিয়ম, সীমাহীন দুর্নীতি, দুঃশাসন, দুর্বৃত্তায়ন ও অব্যবস্থাপনা যা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ের রাষ্ট্রীয় চৌর্যবৃত্তি, অপরাজনীতি ও অনৈতিকতারই প্রতিফলন।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যকে জনগণের মৌলিক অধিকার বিবেচনায় এর দায়ভার সরকার নিজের কাঁধে নেওয়ার পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে তা আরও বেশি করে জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে জনগণের পকেট খরচ ২০১২ সালের ৬৪ শতাংশের যায়গায় ২০২৩ সালে এসে ৭৪ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।
কাজী রকিবুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালের সরকার নির্ধারিত ‘স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশল পত্রে’ এ ব্যয় কমিয়ে ২০৩০ সালে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ফলে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাচ্ছে। মুখে স্বাস্থ্যকে সেবা হিসেবে উল্লেখ করলেও বাস্তবে সরকারের নীতি ও কৌশলে তা পণ্যে পরিণত করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে চালু করা হচ্ছে বাজার অর্থনীতির সব অনুষঙ্গ।
তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ সাধারণ জনগণ চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের উপরই নির্ভর করে থাকে। কিন্তু সেখানেও চিকিৎসা পেতে তাদের পকেট খরচ দিন দিন বেড়েই চলছে। বেশিরভাগ হাসপাতালে রয়েছে জনবলের মারাত্মক ঘাটতি, প্রয়োজনীয় বাজেটের স্বল্পতা, পরীক্ষা- নিরিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও অব্যবস্থাপনা। তদুপরি রয়েছে দালালসহ নানা চক্রের ভোগান্তি। আমরা এর অবসান চাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। স্বাস্থ্য সেবার সংস্কারের ক্ষেত্রে জরুরি সেবাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, সেবার উপকরণের ঘাটতি নিরসন, সেবা প্রদানকারীর বিশেষ নিরাপত্তা প্রদান ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়তে যেসব দাবি জানিয়েছে ডিপিপিএইচ
১. স্বাস্থ্যকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং আইন ও বিধি দ্বারা তা নিশ্চিত করা।
২. ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’ নিশ্চিত করতে জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে প্রাধান্য দিয়ে গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. ১৯৮২ সালে ঘোষিত ওষুধ নীতির মূল কাঠামো ও লক্ষ্য ঠিক রেখে হালনাগাদ করা ও বাস্তায়ন করতে হবে। সেই সাথে ওষুধের মূল্য ও মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪. বিগত আমলের স্বাস্থ্যখাতে সব দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং সংশ্লিষ্ট সবার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান করতে হবে।
৫. ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত থাকা সব চিকিৎসক সংগঠনের সাথে পরামর্শ করে এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।
৬. সরকারি হাসপাতালে ইউজার ফি বাতিল এবং এ পর্যন্ত আদায় করা ইউজার ফি-এর স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করা।
৭. চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল ও রোগীর নিরাপত্তার জন্য রোগী-চিকিৎসাকর্মী বান্ধব সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
৮. স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি করে (এখনই জাতীয় বাজেটের ৮ শতাংশ ও ক্রমান্বয়ে ১৫ শতাংশ এবং জিডিপির ২ শতাংশ ও ক্রমান্বয়ে ৫ শতাংশ) এ উন্নীত করতে হবে।
৯. সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক থেকে বিশেষায়িত পর্যন্ত সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে প্রদান, পর্যাপ্ত ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সংস্থান করতে হবে। চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও উপকরণ এবং প্রয়োজনীয় সকল প্রকার টিকাসামগ্রী সরকারিভাবে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালগুলোর ১০০ শয্যা ও জেলা পর্যায়ে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার সুপারিশ অনুযায়ী হাসপাতালগুলোর শয্যা অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
১১. দেশের জন্য উপযুক্ত রেফারাল পদ্ধতি চালু করতে হবে।
১২. শিল্পায়ন, নগরায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহনের নামে বন উজাড়, নদী ভরাটসহ পরিবেশ বিধ্বংসী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
১৩. জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা চালু রেখে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে পরিকল্পিত নিয়োগ, বদলি বা পদপরিবর্তন এবং চিকিৎসা সহায়ক শূন্য পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
১৪. মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করতে হবে। দালাল ও কমিশন-বাণিজ্যমুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৫. বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অভিন্ন চাকরির বিধিমালা ও বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৬. আইএলও সনদ আনুযায়ী কলকারখানা-চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ ও জনবলের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭. গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং শহরাঞ্চলেও স্বাস্থ্যসেবায় অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।