ঢাকারবিবার , ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নিম্নতম মানব উন্নয়ন সূচক: কেন পিছিয়ে আছে কিছু দেশ?

রঞ্জন দে
ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫ ৫:০০ অপরাহ্ণ । ৬৫ জন

একসময়কার প্রাণবন্ত এক গ্রাম, যেখানে শিশুদের হাসির শব্দ বাতাসে মিশে যেত। কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন সেখানে ক্ষুধার্ত শিশুদের ক্লান্ত দৃষ্টি, মায়েদের উদ্বেগে ভরা মুখ, আর বৃদ্ধদের দীর্ঘশ্বাস। এই গ্রামের নাম দক্ষিণ সুদান, অথবা চাদ, নাইজার, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র কিংবা বুরুন্ডি—নাম আলাদা হলেও গল্পটা এক। এই দেশগুলো আজও টিকে থাকার লড়াই করছে, যেখানে মানব উন্নয়ন সূচকের (HDI) হিসেবে তারা সবচেয়ে পিছিয়ে।

মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index – HDI) একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক, যা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) প্রকাশ করে। এই সূচক নির্ধারণ করা হয় তিনটি প্রধান উপাদানের ভিত্তিতে—জীবন প্রত্যাশা, শিক্ষা এবং আয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সূচকে বিভিন্ন অবস্থানে রয়েছে, তবে কিছু দেশ বহু বছর ধরে নিম্নতম অবস্থানে রয়ে গেছে। এসব দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা মানব উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে কম HDI স্কোরধারী দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ সুদান, চাদ, নাইজার, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং বুরুন্ডি রয়েছে। দক্ষিণ সুদানের HDI স্কোর ০.৩৮৫, যা সবচেয়ে কম। এরপর রয়েছে চাদ (০.৩৯৪), নাইজার (০.৪০০), মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (০.৪০৪) এবং বুরুন্ডি (০.৪২৬)। এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্র খুবই উদ্বেগজনক।

প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত এসব দেশের মানব উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে। দক্ষিণ সুদান ২০১১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। একইভাবে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের গৃহযুদ্ধ এবং বিদ্রোহী কার্যক্রম দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্য এবং খাদ্য সংকট এসব দেশের উন্নয়নকে পিছিয়ে দিয়েছে। নাইজার এবং চাদ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং খরার কারণে এসব দেশে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে শিশুদের অপুষ্টির হার বেড়ে যাচ্ছে, যা তাদের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও এসব দেশ ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। বুরুন্ডি এবং দক্ষিণ সুদানে সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম। স্কুলের অবকাঠামো দুর্বল, পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে এবং অনেক শিশু ছোট বয়সেই শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। এর ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অশিক্ষিত থেকে যাচ্ছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বলতাও একটি বড় সমস্যা। এই দেশগুলোর অনেক এলাকায় আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা নেই, যা শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়িয়ে দিয়েছে। সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেশি, কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসার অভাবে হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর মারা যায়।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও সুসংগঠিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসব দেশকে সহায়তা করলেও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অনাস্থার কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প ব্যর্থ হচ্ছে। তাই এসব দেশের সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কৃষিখাতকে জলবায়ু সহনশীল করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

মানব উন্নয়ন সূচকের নিম্নতম স্থানে থাকা দেশগুলোর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য শুধু আন্তর্জাতিক সাহায্য যথেষ্ট নয়; বরং এসব দেশের নিজস্ব নেতৃত্বের সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুদূরপ্রসারী নীতি প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দিলে ধীরে ধীরে এ দেশগুলোর অবস্থার উন্নতি হতে পারে।