ঢাকাবুধবার , ৯ অক্টোবর ২০২৪
  • অন্যান্য

আজকের সর্বশেষ সবখবর

অসম্পূর্ণ কোর্স বা অতিরিক্ত সেবনে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক
অক্টোবর ৯, ২০২৪ ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ । ৩৩ জন

২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হলে জিহান আরাকে (৩৮) বেশ কয়েকটি পরীক্ষার নির্দেশ দেন চিকিৎসক। এরপরই জানতে পারেন ১৪টি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (রেজিস্ট্যান্স) হয়ে উঠেছে তার শরীর। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন যেসব অ্যান্টিবায়োটিক তার শরীরে প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে, সেগুলোর কোনোটাই তিনি কোর্স সম্পন্ন করেননি অথবা অতিমাত্রায় নিয়েছেন। বাকি মাত্র কয়েকটা অ্যান্টিবায়োটিক আছে যেগুলো তার শরীরে কাজ করবে।

বছর ছয়েকের আফরিন নাবার মাঝে মাঝেই জ্বর-ঠান্ডাজনিত নানা অসুখ হয়। তার মা মনিরা আক্তার জানান, বেশি জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে নিতাম। সাধারণ জ্বরের বা ঠান্ডার ঔষধ দিত। জ্বর বাড়লে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে বলতেন। ৭ দিনের কোর্স থাকলে তিন দিন পর জ্বর কমে গেলে আমি আর অ্যান্টিবায়োটিক দিতাম না। বুঝতে পারিনি যে এটার কোর্স শেষ করতে হবে জ্বর থাকুক বা না থাকুক। এভাবে ৪টি অ্যান্টিবায়োটিক আমার মেয়ের শরীরে প্রতিরোধী হয়ে যায়।

এসব ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, শরীর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত হুমকি। এ তাই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং ঔষধ সেবনের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, সংসদ অনুমোদিত ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ২০২৩ নিবন্ধিত চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের বিক্রি নিষিদ্ধ করে।

ঢাকার বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফার্মাসিস্ট হয় নতুন আইন সম্পর্কে জানে না এবং হাতে গোনা কয়েকজন নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলছেন।

বিশ্বব্যাপী, ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত, অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ পালন করা হয়, যা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ক্রমবর্ধমান সমস্যাকে তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞরা প্রাসঙ্গিক আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণ, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করছেন।

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী কী?

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক শামসুজ্জামান বলেন, ‘মানুষের শরীরে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ অথবা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা না হলে শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নিজ থেকেই প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। একে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে এই সমস্যা আরও বেড়ে যাবে বলে সতর্ক করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘যত বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, তত বেশি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।’

প্রতিরোধের কারণ

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বর্তমান প্রধান ডা. সাজ্জাদ বিন শহীদ বলেন, বাংলাদেশে সর্দি বা জ্বরের মতো সাধারণ রোগের জন্য প্রায়শই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, যার ফলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তিনি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিস্তারকে সংক্রামক রোগের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তিনি বলেন, প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে যেতে পারে, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক উন্নত দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেনা যায় না। তবে বাংলাদেশে এর উল্টো। এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতা সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অনেক লোক বুঝতে পারে না যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে অকার্যকর, যা শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার জন্য ৯৯ শতাংশ দায়ী।

নতুন আইনে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ হবে বলে তিনি আশাবাদী। আগে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা ফার্মেসিগুলোকে শাস্তি দেওয়া হতো না, কিন্তু এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন প্রয়োগ ও জরিমানা করতে পারে।

ঔষধ প্রশাসনের বক্তব্য

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) সাবেক উপপরিচালক এবং আইন কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

তিনি বলেন, পূর্ববর্তী জনস্বাস্থ্য আইনগুলো যথাযথ ছিল না। এ কারণে নিবন্ধিত চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য নতুন বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই আইনের অধীনে আইন ভঙ্গকারীদের ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং তাদের ফার্মেসির লাইসেন্স বাতিলও হতে পারে।

প্রতিরোধ ও সমাধান

অধ্যাপক শামসুজ্জামান অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের আগে অ্যান্টিবায়োটিক কালচার সেনসিটিভিটি টেস্ট করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কোন অ্যান্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে তা এই পরীক্ষাগুলোতে চিহ্নিত করা হলেও খরচ ও সময় ব্যয়ের কারণে বাংলাদেশের মাত্র ১ শতাংশ রোগী এই পরীক্ষা করান।

বিশেষজ্ঞরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিম্নলিখিত পরামর্শ দেন-

১. প্রেসক্রিপশনের জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত করাসহ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
২. রোগীদের নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. অপব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচার শুরু করতে হবে।
৪. সমস্ত স্তরের হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে কালচার টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. অ্যান্টিবায়োটিকের অননুমোদিত বিক্রয় কঠোরভাবে প্রতিরোধে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ফার্মেসিকে জরিমানা

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, ২০২৩ সালের ঔষধ ও কসমেটিকস আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিতরণ করলে ফার্মেসিগুলোকে ২২ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। এই নিয়ম আইনগতভাবে প্রয়োগ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন পরিচালনা করা হবে, যার ফলে দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া এবং দণ্ড কার্যকর করা হবে। আইন অমান্যকারীদের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, এ ধরনের আইন লঙ্ঘন রোধে ফার্মেসি মালিক ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ সতর্কতা জারি করার জন্য ফার্মেসিগুলো পরিদর্শন করবে এবং বৈধ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেউ ঔষধ সরবরাহ করলে তাৎক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।