ই সিগারেট বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব মানা জরুরি বলে জানিয়েছেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বকারীর হোসেন আলী খোন্দকার। গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) যৌথভাবে আয়োজিত এক জাতীয় সেমিনারের তিনি এসব কথা বলেন।
‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কর নীতি’ শীর্ষক এ জাতীয় সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনটিসিসির সমন্বয়কারী। পাবলিকহেলথ২৪.কম এর পাঠকদের জন্য জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বকারীর হোসেন আলী খোন্দকাররে বক্তব্যের দ্বিতীয় পর্ব আজ তুলে ধরা হলো।
তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমদানি নীতি প্রণয়নের বৈঠকে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সবধরনের ভ্যাপসহ ই-সিগারেট বন্ধের প্রস্তাব করেছি। বৈঠক শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহোদয় সাংবাদিকদের বললেন, ই-সিগারেটের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে অবস্থান বা সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেটাই গ্রহণ করবো ।উনি ক্যামেরার সামনেও এ-কথাটাই বললেন যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেটা বলবে, আমরা সেটাই মেনে চলব। পরবর্তীতে আমরা শুনতে পেলাম যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ই-সিগারেট বন্ধের প্রস্তাব রাখা হয়নি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-সিগারেট আমদানি বন্ধ করবে। আইনটা এবার পাস হয়নি, সুতরাং এবারও ই-সিগারেট ব্যান করা হচ্ছে না। তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আইনের ধারার মধ্যে যেটা ছিল, সিনিয়র সচিব মহোদয় যেটা বলেছিলেন, পরবর্তীতে সেটা আর রাখা সম্ভব হয়নি।
তামাকের রাজস্ব আয়ের চেয়ে, তামাকজনিত রোগে ব্যয় বেশি
আমি এনবিআরকে বলব, আপনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়ান। আপনি আমাকে কত দিবেন? বাজেট কত বাড়াব? স্বাধীনতার সময় জাতীয় বাজেট ছিল ৮৮৬ কোটি টাকার। এখন সেই বাজেট সাড়ে সাত ছয় লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই বছর, ২০২৩ সালে স্বাস্থ্যসেবার বাজেট হলো ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রায়। তাহলে আপনি আর কত বাড়াবেন? কতটুকু বাড়াতে পারবেন? রোগ সৃষ্টিকারী তামাক থেকে রাজস্ব আদায় করে দিচ্ছেন, আমি আবার ওই টাকায় আক্রান্ত রোগীদের জন্যে ব্যয় করছি। যারা সিগারেট খায়, বিড়ি-তামাক খায়, তারাই ট্যাক্স দিচ্ছে। আবার তাদের টাকা দিয়েই আপনি তাদের চিকিৎসা করছেন। তাহলে একই তো কথা হলো। বরং যোগ-বিয়োগ করে দেখেন, আপনি আরো লস করছেন। যে টাকা তাদের কাছ থেকে আয় করছেন, তার চেয়ে বেশি টাকা তাদের পেছনে চিকিৎসার জন্য খরচ করছেন। আমাদের অংকে একটু ভালো হতে হবে, জাতীয়ভাবেই। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব।
সরকার কি সব বিষয় দেখবে? অবশ্যই, সব বিষয় দেখার জন্যেই তো সরকার। তাদেরকেই তো সব বিষয় দেখতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি সব জায়গা থেকে আয় করে? এনবিআর কি সব জায়গা থেকে টাকা নেয় ?
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বকারীর হোসেন আলী খোন্দকার
আমি একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম, আকবার আলী খানের লেখা পরার্থ পরতার অর্থনীতি। বাংলাদেশের এই ঢাকা শহরেই এক বিরাট অর্থনীতি আছে, ভিক্ষার অর্থনীতি। এটা কি আপনারা জানেন? যারা ভিক্ষা করে, তারা বিরাট একটা অংক আয় করে। আমি ছোট একটা গল্প বলি। এক ছেলে গিয়ে এক গবেষকের কাছে একটা চাকরি চেয়েছে। তো গবেষক বলেছে, চাকরি দিতে পারব না। তুমি এয়ারপোর্টের সামনে একমাস ভিক্ষা করবে। তাহলে তোমাকে চাকরি দেব। তো ছেলেটা একমাস ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে ভিক্ষা করেছে। পরে তাকে ডেকেছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কি এখন চাকরি চাও? সে বলেছে, না চাকরি চাই না। কেন? সে বলেছে যে আমি মাসে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেছি ভিক্ষা করে। এটা এমন একটা ইনকাম সোর্স যেখানে এনবিআরের হাত দেওয়ার সুযোগ নেই। কেন দেয়নি? কারণ এখানে হাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তারপর দেখুন, এই যে ছিনতাই-চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা— এগুলোতে বিরাট একটা অর্থনীতি। এসব জায়গায় হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। দেওয়া উচিতও না। এরকম অনেক কিছুই আছে।
ঠিক এভাবেই যারা অভ্যাসবশত, অসচেতনতার কারণে ধুমপান করে, তাদেরকে বাঁচানোর জন্যে আমি কি ট্যাক্স বাড়িয়ে কিছু করতে পারি। যারা লাখ লাখ মানুষকে স্লো-পয়েজনিং করে, যারা বিষ বিক্রি করে জনস্বাস্থ্য হুমকীর মুখে ফেলছে সেই সব কোম্পানি ও তাদের পণ্যের ওপর কি বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করা যায় না? আমার মনে হয়,এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করার দরকার আছে। আমরা টাকা নেব,আয় করব ঠিকই, কিন্তু এমন কোনো সোর্স থেকে করব না, যেটা বিশালভাবে পুরো জাতির ক্ষতি করছে।
তিনটি নির্দেশনা আছে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায়
২০৪০ সালের মধ্যে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যে তিনটা নির্দেশনা আছে। একটা হলো স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্যে, একটা হলো এনবিআর-এর জন্যে এবং অন্যান্য অথরিটির জন্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রণালয় হিসাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে লিড করতে হবে। এভাবেই পরে এনটিসিসির মাধ্যমেই পরবর্তীতে আইন সংশোধনের মাধ্যমে নিয়ম-কানুন আরো কড়াকড়ি করার চেষ্টা করেছে। বিধিমালা জারি করা হয়েছে। এনটিসিসির একটা অর্গানোগ্রাম তৈরি করে এরই মধ্যে ফাইন্যান্স ডিভিশনে পাঠানো আছে, এবং তারা নীতিগতভাবে একমত । কিন্তু এই যে একটি উপযুক্ত কর-কাঠামো তৈরি করে তামাক শিল্পের বিষয়টাকে অ্যাড্রেস করার যে নির্দেশনা ছিল, এ বিষয়ে এত বছরেও তেমন কিছু হয়নি। অন্তত: আমি জানি না কিছু হয়েছে কিনা। একখও সেই জটিল কর কাঠামো বহাল আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদোগ্যে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল- এফসিটিসি তে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে ২০০৩ সালে। পরে ২০০৪ সালে সংসদে এটি অনুমোদিত হয়েছে। এর ফলে এটি আইনে পরিণত হয়েছে। যে কারণে স্বাক্ষরকারী এফসিটিসির বাস্তবায়ন না করে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। এবং এফসিটিসির অনুচ্ছেদ ৫.৩-এ যেটা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা খুবই অসচেতন। খুব কম সরকারি কর্মকর্তারাই জানে না কীভাবে এই টোব্যাকো ইন্ড্রাস্ট্রির সাথে মোকাবেলা বা কাজ করতে হবে। আমরা জানি না। আমি এখানে কাজ করতে না আসলে আমিও জানতে পারতাম না। এখানে কাজ করতে আসার পর বুঝলাম যে সুনির্দিষ্ট ইনস্ট্রাকশন বা নির্দেশনা আছে যে সরকারি কর্মকর্তারা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রির সাথে কীভাবে কথা বলবেন বা কীভাবে কাজ করবেন, কীভাবে রি-অ্যাক্ট করবেন।
সুতরাং এ বিষয়টা প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে করতে হবে। এর সাথে মিল রেখে এ বিষয়ে আমরা একটা বিহেভিরিয়াল (আচরণবিধিগত) প্যাটার্ন ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি। অলরেডি এটা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে, মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলে আমরা এটা জারি করে দেব। এভাবে বোধ হয় অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে বলেছে। কয়েকটি নিশ্চিত করেছে। সব মন্ত্রণালয়কে এটা করতে হবে। এটা হলো বাধ্যতামূলক।
তামাক নিয়ন্ত্রণে অন্যদেশের মতো আমরাও পারবো
এই যে রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা এসেছে, স্যার বলেছেন। নিউজিল্যান্ডে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে টোব্যাকো কনজিউমিং জিরোতে (শূন্যে) নামিয়ে আনবে। এটা তাদের ঘোষণা করা এবং তারা অনেকটাই সফল । যখন লাইসেন্সের কথা উঠল, তখন অনেকে বললেন যে লাইসেন্স দিয়ে দিলে তারা তো আর ছাড়বে না। কিন্তু নিউজিল্যান্ড ২০০৯ সালে তারা পাঁচ হাজার লাইসেন্স দিয়েছিল। তাদের আইনে টোব্যাকো লাইসেন্স বিষয়টা আছে। সেখান থেকে এ বছর ছয়শতে নামিয়ে এনেছে। তারা তো পেরেছে। তারা পাঁচ হাজার থেকে ৬০০ তে নামিয়ে আনতে পেরেছে, ২০২৫ সালে শূন্যে নিয়ে যাবে। নিউজিল্যান্ডে এ-ব্যবসা বন্ধ। তো নিউজিল্যান্ড যদি এ ব্যবসা বন্ধ করতে পারে, আমরা পারছিনা কেন? পাশের দেশ ভারতে ই-সিগারেট এরই মধ্যে বন্ধ, সেখানে হার শূন্য।
সুতরাং আমরা করতে পারব না, এটা ঠিক না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ-দেশ অনেক কিছুই করেছে। সুতরাং সিগারেটসহ সবধরনের তামাকের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না,এটা একটা মিথ ছড়ানো হয়েছে। ইনশাআল্লাহ সবাই যদি একসাথে কাজ করি তাহলে পারব।
আমি এনবিআর-কে শুধু বলব যে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়া। দ্বিতীয়ত হলো, এনবিআর-ই কিন্তু স্বাস্থ্য রক্ষার যে টাকা, সেটা আমাদের দিচ্ছে। তো এই টোব্যাকো যদি বন্ধ করতে পারি, তাহলে অনেকক্ষেত্রে খরচের জায়গাটা বন্ধ হবে। ফলে ওই বাজেটটা লাগবে না। আর আপনি যেটুকু দেন, তার চেয়ে বেশি সেভ/সঞ্চয় করতে পারবেন। কয়েক বছর কাজ করে আমার যে ধারণা হয়েছে— তা হলো এই। সুতরাং আমাদের ওদিকে যাওয়ার দরকার।
আরেকটা বিষয় হলো যে আপনি যদি অসুস্থ জাতি তৈরি করেন, তাহলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট কিন্তু পাবেন না। কারণ রোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শুয়ে থেকে অর্থনীতিতে অবদান রাখা যায় না। উন্নয়নে/গ্রোথে কনট্রিবিউট করতে হলে ৪৯ শতাংশ অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হাতকে আসলে কর্মের মধ্যে থাকতে হবে। হাসপাতালে শুয়ে থাকলে কেউ কনট্রিবিউট করতে পারবে না।
দেশের অসংক্রামক রোগের ৭০ শতাংশের সাথে এই তামাকজাত পণ্য দায়ী। এই নেশা দ্রব্যজনিত কারণে সৃষ্ট। এটা বন্ধ করতে পারলেই আমরা বাংলাদেশে সুস্থ-সবল জনগোষ্ঠী পাব। এবং দেখবেন হাসপাতালের করিডোরে-মেঝেতে রোগীদের শুয়ে থাকাটা বন্ধ হবে। আশা করছি যে এটা আমরা করতে পারব।এজন্য সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সবাই ভাল থাকবেন।