ঢাকাসোমবার , ৬ জানুয়ারি ২০২৫

এইচএমপিভি ভাইরাস: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

নিজস্ব প্রতিবেদক
জানুয়ারি ৬, ২০২৫ ২:৪৩ অপরাহ্ণ । ৬০ জন

চীনের সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) অনুসারে, গত ১৬ থেকে ২২ ডিসেম্বর দেশটিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এইচএমপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)-এর সংক্রমণ। শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত অসুস্থতার কারণে বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার, যা কোভিড-১৯, রাইনোভাইরাস বা অ্যাডিনোভাইরাসের চেয়েও বেশি। সাধারণত ১৪ বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। সংক্রমণটি একদম নতুন না হলেও, এই ভাইরাসের বিষয়ে প্রাথমিক সচেতনতায় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই লক্ষ্যে চলুন, এইচএমপিভির প্রকৃতি, কারণ, লক্ষণ এবং এর প্রভাব কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও চিকিৎসার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

এইচএমপিভি কি
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা সংক্ষেপে এইচএমপিভি এমন একটি বায়ুবাহিত ভাইরাস, যা মানুষের শ্বাসনালি (শ্বসনতন্ত্র) ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি সর্বপ্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডসে। পরিবেশে থাকা এইচএমপিভি আক্রান্ত যেকোনো জৈব বা এমনকি জড় উপাদানের সংস্পর্শ থেকে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করে। অতঃপর অন্যান্য শ্বাসনালি ব্যবস্থার ভাইরাসের মতো মুখ নিঃসৃত তরল যেমন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ে।

প্রাথমিকভাবে উপসর্গগুলো সাধারণ ঠান্ডা, জ্বর, কাশির মতো হওয়ার কারণে অনেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। এর সংক্রমণটি সাধারণত শীতের শেষের দিকে এবং বসন্তের শুরুর দিকে ঘটে। বয়স, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের মাঝে ছড়ালেও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় শিশু এবং বয়স্করা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত একটি ভয়াবহ সংক্রামকের নাম এইচএমপিভি। বিশেষত সাম্প্রতিক চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এটি উত্তর এশিয়ায় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এইচএমপিভি সংক্রমণের কারণ
বায়ুবাহিত এইচএমপিভির মূল গন্তব্য থাকে মানুষের শ্বাসনালি। এই গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে পোষক দেহে প্রবেশের জন্য ভাইরাসটি বিভিন্ন ধরণের পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে উপজীবিত করে নেয়। নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলো সংক্রমণের জন্য সহায়ক অবস্থা সৃষ্টি করে।

শ্বাস-প্রশ্বাস ও সংস্পর্শ
দূষিত জৈব বস্তু বা জড়পৃষ্ঠের সংস্পর্শ: এইচএমপিভির মাধ্যমে দূষিত কোনো জীব বা জড়বস্তুর পৃষ্ঠ স্পর্শ করার পর মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করলে সংক্রমণ হতে পারে। ভাইরাসটি নির্দিষ্ট কিছু জড় উপাদানের পৃষ্ঠে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। দরজার হাতল, টেবিল এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মতো মানুষের ধরা-ছোয়ার মধ্যে থাকা জিনিসগুলো এই জীবাণুতে বেশি দূষিত হয়।

মুখ নিঃসৃত তরল: একবার কোনো ব্যক্তি এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হলে তিনি অন্য ব্যক্তিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে সেই ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, বা এমনকি কথা বলার সময় মুখ থেকে বের হওয়া অল্প তরলও সংক্রমণের কারণ হতে পারে। এগুলো অন্য সুস্থ ব্যক্তির গায়ে লেগে বা শ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি শ্বাসনালি পর্যন্ত ঢুকে যাওয়ার শতভাগ আশঙ্কা থাকে।

কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে
শিশু এবং বয়স্ক: রোগ প্রতিরোধ প্রণালী প্রাথমিক অবস্থায় থাকা বা দুর্বল হওয়ার কারণে শিশু এবং বয়স্করা সর্বাধিক সংবেদনশীল থাকে এই সংক্রমণের প্রতি। এছাড়াও পরনির্ভরশীলতার কারণে এরা প্রায়ই অন্যের সংস্পর্শে থাকতে হয়। তাই একটি বাড়ন্ত স্বাস্থ্যবান শিশুও সংক্রমিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

স্বাস্থ্যগত জটিলতা: প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যাদের ক্যান্সার, হৃদরোগ বা শ্বাসনালি সংক্রান্ত দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে, তাদের এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক অবস্থা দুর্বল থাকায় কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই নবাগত ভাইরাস গোটা শরীরকে গ্রাস করে নিতে পারে।

এইচএমপিভি সংক্রমণের লক্ষণ
ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে সংক্রমণের উপসর্গগুলো ভিন্ন রকম হতে পারে। এগুলো প্রধানত দুটি পর্যায়ে দেখা যায়, সেগুলো হলোঃ

১. হালকা লক্ষণ

২. সর্দি বা নাক বন্ধ

৩. কাশি এবং গলা ব্যথা

৪. হালকা জ্বর

৫. প্রচণ্ড ক্লান্তি

গুরুতর লক্ষণ
শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতা

গুরুতর ক্ষেত্রে, বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো বেশি পরিলক্ষিত হয়ঃ

১. শ্বাসকষ্টের তীব্রতা

২. বুক ব্যথা

৩. অবিরাম কাশি

সেকেন্ডারি ইনফেকশন

ভাইরাসের সংক্রমণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রঙ্কিওলাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

অসুস্থতার সময়কাল
হালকা উপসর্গগুলো সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়। তবে কোনভাবে গুরুতর অবস্থায় উপনীত হলে তা দীর্ঘস্থায়ী জটিলতায় রূপ নেয়।

কখন হাসপাতালে নিতে হবে
নিম্নোক্ত অবস্থার সৃষ্টি হলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবেঃ

১. গুরুতর শ্বাসকষ্ট

২. ক্রমাগত জ্বরের প্রচণ্ডতা

৩. শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ যেমন প্রস্রাব কমে যাওয়া

ইচএমপিভি প্রতিরোধের উপায়
শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট সংক্রমণটির জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো চিকিৎসার বিকাশ ঘটেনি। তাই বিস্তার রোধ করার জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্ন জীবনধারণ এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কৌশলগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারে।

স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন
খাবারের আগে ও পরে সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে প্রবেশের সময় হাত-পা ও মুখমণ্ডলের মতো উন্মুক্ত জায়গাগুলো একইভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অ্যালকোহল-ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজারও একটি উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে।

সাধারণ জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
১. শ্বসনতন্ত্রে অসুস্থতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। নিজের মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ অনুভব করলে সুস্থদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ানো এড়াতে তাদের থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা।

২. কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় সর্বদা মুখ এবং নাক টিস্যু বা কনুই দিয়ে ঢেকে রাখা। ব্যবহৃত টিস্যুগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ট্র্যাশবক্সে ফেলে দিতে হবে এবং বক্সটি উন্মুক্ত রাখা যাবে না। বক্স ভরে ওঠার পূর্বেই তা বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে আসতে হবে।

পরিবেশগত ব্যবস্থা
১. দরজার হাতল, সুইচ বক্স এবং মোবাইল ডিভাইসের মতো যে গৃহস্থালি বস্তুগুলো সংস্পর্শে আসার উচ্চ সম্ভাবনা থাকে সেগুলো নিয়মিত স্যানিটাইজ করা।

২. বায়ুবাহিত কণার ঘনত্ব কমানোর জন্য ঘরের ভেতর সঠিক বায়ুচলাচল নিশ্চিত করা।

গবেষণাধীন ভ্যাকসিন
সুনির্দিষ্টভাবে এইচএমপিভি সংক্রমণ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য সরাসরি কোনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি। তবে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ও মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষেধকগুলোকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত গবেষণা চলছে।

এইচএমপিভি নির্ণয় ও চিকিৎসা
বর্তমানে এইচএমপিভি-এর জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। তবে প্রাথমিক অবস্থায় নিম্নোক্ত বিকল্পগুলোর মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

রোগ নির্ণয়
ক্লিনিকাল পরীক্ষা: ডাক্তাররা সাধারণত লক্ষণ, রোগীর স্বাস্থ্যগত প্রোফাইল ও গৃহীত চিকিৎসার ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের প্রক্রিয়াটি শুরু করেন।

পিসিআর টেস্টিং: শ্বসনতন্ত্রে এইচএমপিভি-এর জেনেটিক উপাদান শনাক্ত করার জন্য এই পিসিআর বা পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন পরীক্ষা করা হয়।

অ্যান্টিজেন টেস্টিং: পিসিআরের তুলনায় কম কার্যকর হলেও এই পদ্ধতিটি নমুনায় ভাইরাল প্রোটিন শনাক্ত করতে সহায়তা করে।

ডিফারেনশিয়াল ডায়াগনোসিস: এইচএমপিভির লক্ষণগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা বা আরএসভির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই অন্যান্য শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত অসুস্থতা থেকে এটিকে আলাদা করার জন্য আলাদাভাবে ল্যাব পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে।

প্রয়োজনীয় থেরাপি
তীব্র শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য অক্সিজেন থেরাপি বা যান্ত্রিক বায়ুপ্রবাহ চালনার প্রয়োজন হয়।

প্রয়োজনীয় ঔষধ
প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর এবং ব্যথা কমানোর জন্য অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ঔষধ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে চূড়ান্তভাবে প্রেসক্রিপশন প্রদানের পূর্বে রোগীকে প্রারম্ভিক কিছু টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এর মাধ্যমে তার শরীরে বিদ্যমান স্বাস্থ্যগত অবস্থাকে সুক্ষ্মভাবে যাচাই করা হয়। নিরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী সংশ্লিষ্ট রোগীর জন্য উপযুক্ত ঔষধগুলো নির্বাচন করা হয়।

পরিশিষ্ট
এইচএমপিভি-এর এই কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপায়গুলো সম্বন্ধে সম্যক ধারণা যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বায়ুবাহিত ভাইরাসটি মূলত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই যারা ইতোমধ্যে শ্বাসসংক্রান্ত দুর্বলতায় ভুগছেন তাদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলা এই সংক্রমণ কমাতে পারে।

হিউম্যান প্যাপিলোমা লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন বের হয়নি বিধায় প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য অগ্রিম সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।