ঢাকাবুধবার , ৮ জানুয়ারি ২০২৫
  • অন্যান্য

কনডম: ইতিহাস ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা

রঞ্জন কুমার দে
জানুয়ারি ৮, ২০২৫ ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ । ১৭ জন

কনডম, যা যৌনস্বাস্থ্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। এর ইতিহাস বহু পুরোনো। এটি মূলত জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে এর ব্যবহার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ একটি পথচলা।

প্রাচীন মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ১,০০০ সালের দিকেই যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য পুরুষরা পশুর অন্ত্র, লিনেন কাপড়, এমনকি বস্ত্রজাতীয় উপাদান ব্যবহার করত। এগুলো কনডমের প্রথমিক রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীন ও জাপানের প্রাচীন সভ্যতাতেও এ জাতীয় প্রতিরোধক ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। চীনে তেল-ভেজানো কাগজ এবং জাপানে কচ্ছপের খোলস বা পশুর শিং দিয়ে তৈরি সরঞ্জাম ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে।

মধ্যযুগে যৌনবাহিত রোগ সিফিলিসের মহামারি ইউরোপে ভয়াবহ রূপ নেয়। এই সময় ইতালীয় চিকিৎসক গ্যাব্রিয়েল ফেলোপিয়াস লিনেন দিয়ে তৈরি একটি প্রতিরোধক আবিষ্কার করেন। এটি মূলত সিফিলিস প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হতো এবং এটি আধুনিক কনডমের পূর্বসূরী হিসেবে পরিচিত।

১৬০০ শতকের দিকে ব্রিটেনে কনডমের প্রচলন শুরু হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, ব্রিটিশ রাজা দ্বিতীয় চার্লসের চিকিৎসকের নাম ছিলো ডক্টর কন্ডম। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করতে তিনি রাজার জন্য একটি প্রতিরোধক তৈরি করেন। এখান থেকেই “কনডম” নামটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।

১৮৩৯ সালে চার্লস গুডইয়ার রাবার ভলকানাইজেশনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এর ফলে ১৮৫৫ সালে প্রথম রাবার কনডম তৈরি হয়। এটি তুলনামূলক সস্তা, টেকসই এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য হওয়ায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ১৯২০ সালে লেটেক্স দিয়ে তৈরি কনডম বাজারে আসে। লেটেক্স কনডম হালকা, টেকসই এবং অধিক কার্যকর হওয়ায় এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে লেটেক্স কনডমেরই উন্নত সংস্করণ সর্বাধিক ব্যবহৃত হচ্ছে। কনডম তৈরিতে প্রযুক্তির উন্নতি ও নতুন উপকরণের সংযোজন এটি আরও কার্যকর এবং আরামদায়ক করেছে।

শুরুতে কনডমের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা ছিল। ১৮শ ও ১৯শ শতকে অনেক সমাজে এটি অনৈতিক এবং অসামাজিক কাজ বলে বিবেচিত হতো। তবে ২০শ শতকের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও যৌনস্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করার পর কনডমের ব্যবহার ক্রমশ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে।

বিশেষ করে, এইডস মহামারির সময়ে কনডম ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধক উপাদান হিসেবে উঠে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কনডম ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালায়। অনেক দেশ তাদের পরিবার পরিকল্পনা নীতিমালার অংশ হিসেবে কনডম বিতরণ শুরু করে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেও কনডম বিতরণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে।

কনডমের ব্যবহার নিয়ে সামাজিক ট্যাবু থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুল ও কলেজে যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বিনামূল্যে কনডম সরবরাহের কারণে কনডমের ব্যবহার বাড়ছে।

আজকের দিনে কনডম শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়, যৌনবাহিত রোগ যেমন এইচআইভি, সিফিলিস, গনোরিয়া প্রতিরোধেও একটি অত্যন্ত কার্যকর উপাদান। এটি বিভিন্ন ধরনের, আকার এবং বৈশিষ্ট্যসহ বাজারে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশেও কনডম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে কনডমের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এখনো অনেক অঞ্চলে সামাজিক ট্যাবু এবং সচেতনতার অভাব কনডম ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে।

কনডমের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ। পিল বা অন্যান্য রাসায়নিক পদ্ধতির তুলনায় কনডমের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটি সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং ব্যবহারে ঝুঁকিমুক্ত।

কনডমের ইতিহাস শুধু একটি প্রতিরোধক উপাদানের বিবর্তনের গল্প নয়, এটি সমাজ, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির একটি প্রতিচ্ছবি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কনডম শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নয়, জনস্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। আধুনিক সমাজে কনডমের ব্যবহারকে আরও সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য করার মাধ্যমে যৌনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং নিরাপদ যৌনজীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।

বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কনডম আরও কার্যকর ও আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। এটি শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়, বরং যৌনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য। শিক্ষার প্রসার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কনডম ব্যবহারের হার আরও বাড়ানো সম্ভব, যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও টেকসই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।