রাত ১০টা। হাসান সাহেব এখনো অফিসে। দিনের পর দিন অতিরিক্ত কাজের চাপ, কম ঘুম, এবং ধোঁয়াটে পরিবেশে কাজ করতে করতে শরীর যেন ভেঙে পড়ছে। কিছুদিন ধরেই হাত-পায়ের জয়েন্টে ব্যথা অনুভব করছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, বয়সের কারণে এমন হচ্ছে, কিন্তু ডাক্তার জানালেন—তিনি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে (RA) আক্রান্ত। প্রশ্ন জাগে, তাঁর কর্মপরিবেশ কি এ রোগের জন্য দায়ী?
সম্প্রতি ন্যাশনাল রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সোসাইটি (NRAS) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু পেশায় কাজ করা মানুষের মধ্যে স্বয়ং-প্রতিরোধী রোগের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে, যারা রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকেন, ধুলাবালিতে কাজ করেন বা দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তাদের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (RA), মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS), এবং লুপাসের মতো রোগের প্রবণতা বেশি হতে পারে। (সূত্র: NRAS, ২০২৪)
গবেষণাটি আরও দেখিয়েছে যে, যেসব শ্রমিক নিয়মিত ধোঁয়া, ধুলাবালি এবং বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে থাকেন, তাদের ইমিউন সিস্টেম দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হয়। স্টকহোম ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকও একই ধরনের ফলাফল পেয়েছেন। তারা বলেছেন, “কর্মস্থলের দূষিত বায়ু ও রাসায়নিক পদার্থ শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে আক্রমণ করে, যা স্বয়ং-প্রতিরোধী রোগের প্রবণতা বাড়াতে পারে।”
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (NIOSH)-এর একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, যারা নির্মাণশিল্প, কৃষি, এবং রাসায়নিক উৎপাদন সংস্থায় কাজ করেন, তাদের মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা, ত্বকের প্রদাহ এবং দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণের হার তুলনামূলক বেশি।
বিশেষ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তারা দীর্ঘ সময় ধরে সেলাই মেশিনের সামনে বসে কাজ করেন, যা তাদের হাড়ের গঠন ও পেশিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, তুলা, কেমিক্যাল ডাই, এবং ফ্যাক্টরির বদ্ধ পরিবেশ তাদের শ্বাসযন্ত্রের রোগ, চর্মরোগ এবং স্বয়ং-প্রতিরোধী রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে বাতের ব্যথা, একজিমা ও অ্যালার্জির হার তুলনামূলক বেশি, যা কর্মপরিবেশের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
বাংলাদেশের জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, “আমাদের দেশে শিল্প কারখানার শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলো বলছে, কর্মপরিবেশের কারণে দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। আমাদের এখনই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সায়েদা আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ও কৃষি খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে আর্থ্রাইটিস, শ্বাসকষ্ট ও ত্বকের রোগের হার বাড়ছে। কিন্তু এসব বিষয়ে তেমন কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই। কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবান্ধব নীতি চালু করা জরুরি।”
পেশাগত স্বাস্থ্য গবেষক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, “শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতি ছাড়া এ সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। কর্মক্ষেত্রে বিশুদ্ধ বায়ু, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম বাধ্যতামূলক করা উচিত।”
বিশেষজ্ঞরা কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন:
বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা: কর্মস্থলে উন্নতমানের বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা থাকতে হবে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: কর্মীদের জন্য বছরে অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুরক্ষা সরঞ্জাম: রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে যারা কাজ করেন, তাদের জন্য উন্নতমানের সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতা বৃদ্ধি: কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকেন।
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: মানসিক চাপ এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টার নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কার্যক্রম চালু করা দরকার।
কর্মঘণ্টা নির্ধারণ: অতিরিক্ত ওভারটাইম কমিয়ে কর্মীদের জন্য বিশ্রামের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।
পেশাগত স্বাস্থ্য কেবল ব্যক্তির সমস্যা নয়, বরং এটি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার সঙ্গেও জড়িত। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা হলে, স্বয়ং-প্রতিরোধী রোগের হার কমবে এবং কর্মীরা সুস্থ থেকে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সরকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, স্বাস্থ্যবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি কেবল তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং এটি জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।