ঢাকামঙ্গলবার , ৭ নভেম্বর ২০২৩

কালাজ্বর নির্মূলে বাংলাদেশের অনন্য অর্জন

নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ৭, ২০২৩ ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ । ২৪৫ জন

সম্প্রতি কালাজ্বর নির্মূলে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ৩১ অক্টোবর, সোমবার, দুপুরে ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ৩ দিন ব্যাপী চলা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭৬-তম দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি’র হাতে এই স্বীকৃতির সনদপত্র তুলে দেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পুনম খেত্রপাল। আসুন জেনে নেই কালাজ্বরের আদ্যোপান্ত।

কালাজ্বর একটি প্রাণঘাতী রোগ। মেডিকেলের ভাষায় এটি ভিসারাল লিশম্যানিয়াসিস হিসেবে পরিচিত। এটি লিশম্যানিয়া পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট যা স্ত্রী স্যান্ডফ্লাই (বেলেমাছি) কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। সময়মত চিকিৎসা না হলে প্রায় ৯৫% কালাজ্বর রোগীর মৃত্যু হয়। এই জ্বরের প্রধান লক্ষণসমূহ অনিয়মিত দীর্ঘমেয়াদী জ্বর, প্লীহা এবং যকৃতের বৃদ্ধি, ওজন হ্রাস, এবং রক্ত স্বল্পতা।

কালাজ্বর একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ যা সমাজের অবহেলিত ও প্রান্তিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমিত হয়। এ রোগের প্রার্দুভাব বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে দেখা যায় এবং প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগের ঝুঁকিতে থাকে। ব্রাজিল, পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারতবর্ষে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়। প্রতিবছর আনুমানিক ৫০ হাজার থেকে ৯০ হাজার নতুন কালাজ্বর রোগী বিশ্বব্যাপী সনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ৯০% রোগী ১৩টি দেশের অন্তর্গত। বাংলাদেশে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে।

১৮২০, ১৮৬০, ১৯২০ এবং ১৯৪০-এর দশকে বাংলায় কালাজ্বর মহামারীর ঢেউ পরিলক্ষিত হয়। ১৯৩১-১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন বাংলায় প্রায় ১০ লাখের বেশি কালাজ্বরের রোগী সনাক্ত হয়েছে। কালাজ্বর সর্বপ্রথম ১৮২৪ সালে যশোর জেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল যার বেশিরভাগ অংশ এখন বাংলাদেশে। ১৯ শতকের মধ্যে এই রোগটি পশ্চিম-পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ উভয়ের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগটির বাহক বেলেমাছি, মানব সংক্রমণের রিজার্ভার (Reservoir) এবং সংক্রমণ চক্র ২০ শতকের প্রথম ৩ দশকে উদ্ঘাটন হয়েছিল।

২০ শতক জুড়ে কালাজ্বর দক্ষিণ এশিয়ায় একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। ১৯১০-এ কার্যকর চিকিৎসা হিসেবে প্রথম ট্রাইভ্যালেন্ট অ্যান্টিমনি ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু এটি অত্যন্ত বিষাক্ত ছিল। এর পরে কিছুটা কম বিষাক্ত পেন্টাভ্যালেন্ট অ্যান্টিমনি
ছিল যা সমানভাবে কার্যকর ছিল, এটি ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রথম সারির চিকিৎসা ছিল। এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ অধিকতর কার্যকর AmBisome এবং Miltefosine দ্বারা কালাজ্বর রোগের চিকিৎসা করা হয়।

বাংলাদেশে, ৭০ এর দশকে বিভিন্ন এলাকায় কিছু সংখ্যক কালাজ্বরের রোগী সনাক্ত করা হয়েছিল এবং ৮০ সালে পাবনা জেলায় একটি প্রার্দুভাব ঘটেছিল। তারপর থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে কালাজ্বর সংক্রমণ হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১১ সময়কালে কালাজ্বর রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে ২৬টি জেলার মোট ১০০টি উপজেলাকে কালাজ্বর উপদ্রুত উপজেলা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং তার বাস্তবায়ন ইউনিট (IUS) উপজেলা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল।

২০০৫ সালে বাংলাদশ, ভারত এবং নেপাল সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে কালাজ্বর রোগকে নির্মূল (উপজেলা পর্যায়ে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ১ এর কম রোগী) করার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যার মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ২০১৭ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে ভুটান এবং থাইল্যান্ডকে অর্ন্তভুক্ত করে সমঝোতা স্মারক (MoU) হালনাগাদ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে জাতীয় কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচী (NKEP) বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের ২০০৫ সালের কৌশলগত কাঠামো অনুসরণ করে ২০০৬ সালে তাদের জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।

জাতীয় কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচীর কর্মকৌশলের স্তম্ভগুলি হলো
১. দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সম্পন্ন করা
২. সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা এবং বাহক নজরদারি
৩. রোগের নজরদারি শক্তিশালী করা
৪. অপারেশনাল রিসার্চ
৫. অ্যাডভোকেসি, কমিউনিকেশন অ্যান্ড সোশ্যাল মোবিলাইজেশন (ACSM)
৬. মাল্টিসেক্টরাল এবং আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা।

কালাজ্বর বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল আইন ২০১৮ এর অধীনে একটি লক্ষণীয় রোগ। বাংলাদেশে কালাজ্বর উপদ্রুত এলাকায় ২২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেকে কালাজ্বর রোগের বিনামূল্যে রোগ নির্ণয় ও সম্পূর্ন চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলো সরকারি প্রাথমিক পরিচর্যা কেন্দ্র, যেখানে NKEP ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার সরঞ্জামাদি ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করে থাকে।

এছাড়াও সাতটি রেফারেল হাসপাতালে কালাজ্বরের জন্য বিশেষায়িত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পরিসেবা প্রদান করা হয়। প্রাথমিকভাবে কালাজ্বর রোগের লক্ষণের উপস্থিতির পাশাপাশি rK39 ডায়াগনস্টিক টেস্ট এর ফলাফলের ভিত্তিতে কালাজ্বর সনাক্ত করা হয়। সাতটি টারশিয়ারী হাসপাতাল (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল (ঢাকা), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা) এবং সূর্যকান্ত কালাজ্বর গবেষণা কেন্দ্র (SKKRC: ময়মনসিংহ) জটিল কালাজ্বর রোগীদের উন্নত ডায়াগনস্টিক এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়।

বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে NKED ধীরে ধীরে কালাজ্বর রোগের সংক্রমণ কমিয়ে এনেছে (উপজেলা পর্যায়ে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ১ এর কম রোগী) এবং ২০১৮ সাল থেকে এই ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। এতে বাংলাদেশে “জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে কালাজ্বর নির্মূল হয়েছে” বলে ঘোষণার যোগ্যতা অর্জন করে।

দেশের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র কাছে একটি ডসিয়ার জমা দিয়েছিল। দাবির স্বতন্ত্র বৈধতার পর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি “জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে কালাজ্বর নির্মূল লক্ষ্য অর্জন করেছে।

এই সনদটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য গৌরবের ও সম্মানের। আমরা এও জানি যে, নির্মূলের এই ধারা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিগণিত হবে। যাচাইকরণের রিপোটিং উন্নত ডায়াগস্টিক বিশেষ করে পরের পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে RDT rk39 প্রাপ্যতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে Evidence based শূন্য কালাজ্বর মলিকুলার অ্যাসে এর মাধ্যমে সুনিশ্চিতভাবে জটিল কালাজ্বর, দ্রুত ও নির্ভূল ভাবে নেশা না করে যায়। ২০০০ সালের মধ্যে শূন্য কালাজ্বর” অর্জনের লক্ষ্যে, এই পর্যায়ে রোগ নির্ণয় চিকিৎসা, নজরদারি এবং ভেক্টর নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করার জন্য অধিকতর কিনোস বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। অন্যথায় তিন বছর পর মূল্যায়নের মাধ্যমে কালাজ্বরের এই গৌরব হারাতে
পারে।