ঢাকাবুধবার , ১ জানুয়ারি ২০২৫

গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সার্জেলের বার্ষিক বিক্রি হাজার কোটি টাকা!

রঞ্জন কুমার দে
জানুয়ারি ১, ২০২৫ ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ । ৬৫ জন

বাংলাদেশে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা যেন এক সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ মজুদ রাখা হয়, এবং এই তালিকায় অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ হল সার্জেল। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, সার্জেলের বার্ষিক বিক্রি এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই বিশাল পরিমাণ বিক্রি কেবল আর্থিক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বরং এটি দেশের খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।

সার্জেলের জনপ্রিয়তার কারণ সার্জেলের মূল উপাদান ওমেপ্রাজল, যা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (পিপিআই) শ্রেণির একটি ওষুধ। এটি পেটে অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপাদন রোধ করে। দেশের বড় একটি অংশ প্রতিদিন এই ওষুধ গ্রহণ করছে, যার মূল কারণ হিসাবে চিকিৎসকরা বেশ কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছেন।

ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ আজম বলছেন, “আমাদের দেশে অনিয়মিত খাবারের অভ্যাস, অতিরিক্ত মশলাদার খাবার, এবং স্ট্রেসজনিত কারণে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়েছে। এই সমস্যার জন্য সার্জেল একটি সহজ এবং কার্যকর সমাধান হিসাবে দেখা দিয়েছে।”

বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসে ভাজা-পোড়া এবং অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবারের আধিক্য রয়েছে। রাস্তার পাশের খাবার এবং অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়াতে পারে। রাস্তার খাবার প্রায়শই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত হয় এবং এতে ব্যবহৃত তেল ও উপকরণ নিম্নমানের হতে পারে, যা হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে। এ ধরনের খাবারে ব্যবহৃত অনিরাপদ পানি, নোংরা পাত্র, এবং ধুলাবালির কারণে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটতে পারে, যা পেটের সমস্যা বাড়ায়।

অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে, যা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়ায়। এ ধরনের খাবারে উচ্চমাত্রার চিনি এবং ফ্রুক্টোজ থাকে, যা হজমে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং পেটে গ্যাসের পরিমাণ বাড়ায়।

এ ছাড়া, অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত খাবারও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার হজমে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং পেটে গ্যাসের সমস্যা বাড়ায়। সুতরাং, রাস্তার পাশের খাবার এবং অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়াতে পারে। এ ধরনের খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

পাশাপাশি, কর্মজীবীদের জন্য সময়মতো খাবার না খাওয়া এবং মানসিক চাপও বড় কারণ। এই সমস্ত সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে সার্জেল বহুল ব্যবহৃত।

সার্জেলের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হওয়া চিকিৎসা খাতের একটি বিস্ময়কর তথ্য। এ সম্পর্কে ফার্মাসিউটিক্যাল বিশেষজ্ঞ কাজী সালাহউদ্দিন জানান, “এটি শুধু ওষুধের চাহিদাই নয়, দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের প্রবৃদ্ধিরও একটি চিত্র।” সার্জেলের জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা কতটা ব্যাপক এবং এটি সমাধানে মানুষ কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন টাকার বেশি আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের অংশ উল্লেখযোগ্য। শুধু সার্জেল নয়, একই ধরনের অন্যান্য ওষুধ যেমন নেক্সিয়াম, রেনিটিডিন, এবং প্যান্টোপ্রাজলও প্রচুর বিক্রি হয়। কিন্তু সার্জেলের সহজলভ্যতা, সাশ্রয়ী মূল্য এবং দ্রুত কার্যকারিতার জন্য এটি অন্যান্য ওষুধের চেয়ে এগিয়ে।

গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার এত ব্যাপকতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, পিপিআই ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহিন আলম বলেন, “গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য পিপিআই ওষুধ কার্যকর হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে হাড়ের ক্ষয়, কিডনির সমস্যা, এবং ভিটামিন বি১২-এর অভাব হতে পারে। তাই আমরা রোগীদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।”

বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ওষুধের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। বরং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও মদ্যপান এড়ানো, এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন তারা।

সার্জেলের ব্যবহারে রোগীদের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন ধরনের। কিছু মানুষ এটি গ্রহণের পর দ্রুত আরাম পেয়েছেন, আবার কেউ দীর্ঘমেয়াদে এটি ব্যবহার করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রুবিনা সুলতানা জানান, “আমার পরিবারে সার্জেল প্রায় প্রতিদিন ব্যবহার করা হয়। একটু ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার খেলেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয়। সার্জেল না হলে যেন জীবন চলে না।”

অন্যদিকে, চট্টগ্রামের একজন চাকরিজীবী তারিকুল ইসলাম বলেন, “আমি অনেকদিন ধরে সার্জেল নিচ্ছি। কিন্তু এখন আমার হাড়ের সমস্যার কথা চিকিৎসক বলেছেন, যেটি এই ওষুধের কারণে হতে পারে। এখন চেষ্টা করছি খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখার।”

সার্জেলের মতো গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের চাহিদা বৃদ্ধি আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে। দেশের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার প্রকোপ কমতে পারে। পাশাপাশি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসকদের সঠিক পরামর্শের মাধ্যমেও ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব।

সরকারি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রচারণা চালানো হলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা কমতে পারে। একই সঙ্গে, চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টদের ওষুধ ব্যবহারে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত।

সার্জেলের বার্ষিক বিক্রি এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হওয়া বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। এটি যেমন একটি সফল ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, তেমনই এটি দেশের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং জীবনধারার একটি প্রতিচ্ছবি। সার্জেলের মতো ওষুধের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পেতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং সচেতনতার বিকল্প নেই।