ঢাকাসোমবার , ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গ্রামীণ কৃষি কৃষ্টি পরিবর্তনের অসংগতি

রতন মণ্ডল
সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৩ ৩:৩০ অপরাহ্ণ । ৬৮৪ জন

কৃষি মানব সমাজের মূল শিল্প এবং মানব সভ্যতার মূল বুনিয়াদ। আদিম পর্যায়ে পৃথিবীতে মানুষ বুদ্ধি-বৃত্তি চিন্তাশক্তি দ্বারাই প্রথমে অনায়াসে লতাপাতা ফলমূল গ্রহণে ক্ষুধা নিবারণ করতো। পরবর্তীতে পশু শিকারে যাযাবর জীবন থেকে ফসল চাষাবাদের মধ্যে দিয়েই মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। প্রায় দুই লক্ষ বছরের মানুষের ইতিহাসে চাষবাস শুরু মোটামুটি দশ থেকে বারো হাজার বছর আগে। এক সময় বনে জঙ্গলে ভরা এই বাংলায় আদিবাসীরাই প্রথমে জঙ্গল কেটে চাষাবাদ শুরু করে এবং স্থায়ী বসবাসের উপযোগী করে তোলে। ধীরে ধীরে কৃষির ওপর ভিত্তি করেই মানব সভ্যতার বিশাল কাঠামো দণ্ডায়মান ও যন্ত্রশিল্পের বিকাশ।

বর্তমান তা বিকাশ বৃদ্ধিতে আধুনিক প্রযুক্তিতে এসেছে। ১০,০০০ বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে কৃষিতে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ৯,৯০০ বছর ধরে চালু ছিলো। ১০০ বছরেরও কম সময়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষ নির্ভর কৃষির দাপটে মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কৃষিকে ভিত্তি করেই শোষক শ্রেণীর উত্থান এবং মানব সমাজ হয়েছে শ্রেণীবিভক্তির এক জটিল অবস্থা। পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ-সংস্কৃতি।

গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বহু বিবর্তন হয়েছে। সাথে এসছে অজস্র অসঙ্গতি এবং হয়েছে অনেক অসামঞ্জস্যতা। কৃষি যুগের সূচনা লগ্নে গুহা ছেড়ে বসবাস করতে শুরু করে তখন মাটির ঘর তৈরি করে। এখন পর্যন্ত মানুষের সৃষ্টিশৈলীর মাটির ঘর প্রাচীনতম নিদর্শন। আড়ম্বের আধিক্য না থাকলেও আছে গরম ও শীতকালে আয়েশ মাখা প্রশান্তির পরশ। প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ইহা জীবের জন্য ক্ষতিকর তড়ঙ্গ বা রশ্মি প্রতিরোধী। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কএর প্রতিবন্ধকতাই তা প্রমাণ করে।

আজ উন্নয়নের ছোঁয়ায় আবাদী জমির উপরিভাগের নরম জৈব পদার্থসমৃদ্ধ উর্বর জীবন্ত মাটি পুড়ে তৈরি করছে কঠিন কনক্রিট ইটের বাড়ি। এই এক মুষ্টি মাটি চাষের উপযোগী করতে ৪০০ বছর সময় লেগে যায়। অথচ আজ গ্রামেও তৈরি হচ্ছে বাংলার জলবায়ুর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কবুতরের খোপের ন্যায় ফুটি বাসা। রাস্তার পাশে আবাদি জমির উপর হচ্ছে শতশত বাড়ি। আবার ফসলের মাঠের নরম মাটির পোড়া ইট চলে যাচ্ছে কঠিন কনক্রিটের শহর তৈরিতে। আর শহর হতে বর্জ্য বিষ আসছে নদী নালা খাল বিল মাঠে ঘাটে আবাদি জমিতে।

মাটির বাড়ি তৈরি করতে পাড়ার আশেপাশে মাটি খনন করে তৈরি হতো ছোট বড় অসংখ্য জলাধার। আবার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বড় পুকুর খনন ও শানে ঘাট বাঁধানো ছিল মর্যদাপূর্ণ কর্ম । জলসংকট নিরসনে রাজা জমিদারদের উদ্যোগে খনন করা হতো বিশাল বিশাল দীঘি। এসব জলাধার পানির নিম্নগামী পরিশ্রবণের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিরস্তর উপরের উঠিয়ে আনে। দেশে যে কয়েকটি বিশাল দিঘী বর্তমান তার সবই অনেক অনেক বছর আগের। গত পাঁচ-দশ দশক যাবত একটিও দীঘি কিংবা বড় পুকুর খননের ইতিহাস নেই। দু-চার দশক আগেও মানুষ স্নান, দৈনন্দিন ব্যবহার ও কৃষি সেচে ভূপোরিভাগের বিশেষকরে পুকুর নদী বিল-ঝিলের পানি ব্যবহার করতো।

আজ গ্রামের লোকজনও সেসব জালাধার পরিত্যাগ করে মটর চালিয়ে প্রায় শতভাগ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করছে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের দাম্ভিকতায় অগভীর ও গভীর নলকূপ দ্বারা পানি উত্তোলনে ১৯৮৮ সাল থেকে বরেন্দ্রভূমির অনেক অংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩৯ ফুট থেকে ৫৯ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। ফলে পানির সাথে আয়রন, আর্সেনিক সহ অনেক বিষাক্ত উপাদান পানির সাথে মিশে দূষিত হয়ে অনেক এলাকায় পানি পানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ঘেঁষে ভারতে আজ গ্রামাঞ্চলেও ভূগর্ভস্থ পানি পানের অনুপযোগী হওয়ায় ফিল্টার করা পানি ক্রয় করে পান করছে। আমাদেরও পানি ক্রয় করে পান করতে বাধ্য হতে হবে সে দিন আর বেশি দূরে নয়।

বর্তমানে জলাশয় মাটিসহ বায়ু দূষণে কৃষি কাজ-কর্মও দায়ী। আগের দিনে ফসল চাষ আবাদে জমির উর্বরতার জন্য প্রকৃতিকভাবে প্রাপ্ত যেমন গোবর সার, কম্পোস্ট ব্যবহার করত। এমনকি পুকুর বা খালের হিউমাস সমৃদ্ধ কাদা মাটি (কোন অঞ্চলে গলা মাটি বলে) সার হিসেবে ব্যবহার করত। বর্তমানে জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে রাসায়নিক সারই যেন একমাত্র উপায়। এসব সার হলো রাসায়নিক পদার্থ। এর মাত্রাতিরিক ও ভুলভাবে ব্যবহারে মৃত্তিকা ও পানির পরিবেশকে নানাভাবে দূষিত করছে। জমিতে ব্যবহৃত সারের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ অপচয় হচ্ছে, যা সরাসরি মাটি কিংবা পানি এমনকি পরিশ্রবণে ভূগর্ভস্থ পানি দুষিত করছে।

বাংলাদেশের জনঘনত্ব অধিক ত্রায় বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত চাষে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে এবং আরো অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার করে দূষণের মাত্রা এখন চড়মে। দেশে এখন অতিরিক্ত এবং এই বিপুল জনগণকে খাওয়ানোর জন্যই আরও খাদ্য উৎপাদন করতে হচ্ছে। এর জন্যেই নাকি এতো আয়োজন। ১৯৯৩-৯৪ সোয়নিক সারের চাহিদা ছিল ২২.২৯ লক্ষ টন আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬০.০০ লক্ষ টনেরও বেশি। তা বাড়িয়ে কৃষিবিভাগ কর্তৃক নির্বিত ও সম্প্রসারিত চাষাবাদের প্রয়োজনে ২০২১-২২ অর্থবছরে রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ করেছে মোট ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। অধিক সার ব্যবহারে কৃষকরা মনে করছে ফসল ভালো হচ্ছে। কিন্তু জমিতে সার ব্যবহারের ফলে ক্রমে উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। তার একটি প্রমাণ হচ্ছে প্রতি হেক্টর জমিতে আগের তুলনায় আরও বেশি সার দিতে হচ্ছে।

২০০২ সালে প্রতি হেক্টরে ১৮৮.৬ কেজি সার দিতে হতো, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৮৯.৪ কেজি, প্রায় ১০০ কেজি বেশি সার দিতে হচ্ছে, অথচ ফলন সেই তুলনায় বাড়ছে না। অন্যদিকে মাটি নির্জীব ও নষ্ট হচ্ছে, জলাশয়ের পানি বিষাক্ত হচ্ছে। মরছে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। অথচ এর বিপরীতে জৈব সার ব্যবহার শূণ্যতে নেমেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মূলত জার্মানির হাত ধরে কৃষি কার্যে ব্যবহার করা হতে থাকলো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। বহুজাতিক কম্পানির কূটকৌশলে ও সরকারের উদাসীনতায় কৃষকরা আজ যেন রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের উপরই পুরোপুরি নির্ভশীল। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগ ছারখার করে দিয়েছে প্রাকৃতিকভাবে পোকা নিধনকারী ব্যাঙ, ফড়িং, মাকড়শাসহ অসংখ্য পতঙ্গ। আজ কৃষিতে অপকারী পোকার জন্মহার বর্তমানে বিপুল বেড়ে গিয়ে তারা কীটনাশক সহনশীল হয়ে আরো অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে উঠেছে। এতে আরো অতিমাত্রায় ব্যবহার হচ্ছে বিষ। প্রতিটি বাস্তুতন্ত্র এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

বিষ রাসায়নিক ভারি পদার্থ মানুষের কোষে জমা হতে থাকলে স্নায়ুতন্ত্রিক সিগন্যাল দেহের নির্দেশ অনুসারে কাজ না করে, অস্বাভাবিক কাজ করে । বর্জ্য ও বিষক্রিয়ার ফলে বাড়ছে টিউমার, ক্যানসারসহ ভয়ঙ্কর মরণব্যাধী রোগ। তাতে চিকিৎসা ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে ওঠছে। বর্তমানে আবার এই কীটনাশক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকার এই বার্তা প্রচার হলে কর্পোরেট কোম্পানি পোকা দমনে বা প্রতিরোধে আর এক মরণঘাতি জিএমও (জেনেটিকালী মডিফাইড ওরগানিজম) শস্য বিটি বেগুন, গোল্ডেন রাইচ ইত্যাদি চাষাবাদে পুঁজিবাদের আর এক নতুন ফাঁদ পেতেছে। জিএমও জাতীয় শস্য চাষ তো আরো ক্ষতিকর। বিষ এতদিন ছিল শস্যের বাইরে, এখন শস্যের ভেতরে যাচ্ছে। এটা কৌলিকতান্ত্রিকভাবে সমস্ত ইকো-সিস্টেমকে ধ্বংস করবে।

আগের দিনে কৃষক তাদের মেধা, জ্ঞানের ব্যবহার করে চাষের জন্য বীজ বাড়িতেই স্থানীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করত। এখন বহুজাতিক সংস্থার চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপনে তাদের উৎপাদিত বীজ কৃষক ক্রয় করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল সেসব সংস্থাই আবার সংগ্রহ করে সব স্তরের ভোক্তার কাছে নিয়ে বিক্রি করছে নিশ্চিত উচ্চ লাভে। ফলে সকল কৃষক নিজস্ব বীজ সংরক্ষণ জৈব সার ব্যবস্থাপনার জ্ঞান ভুলে ও হারিয়ে ফসল উৎপাদনের সকল উপকরণ বহুজাতিক কোম্পানীর কাছ হতেই নিতে অভ্যস্ত এবং পরে বাধ্য হচ্ছে। আর অন্যদিকে ভোক্তারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে অক্ষম হয়ে ঐসব বহুজাতিক সংস্থার কাছ থেকে নিতে বাধ্য। অল্প কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থাই উপনিবেশ বানিয়ে ফেলেছে গোটা পৃথিবীকে। তারাই খাদ্যের নিয়ন্ত্রক। আজ কৃষি কৃষ্টি প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন হয়ে কৃষক ও ভোক্তা পুঁজিবাদীদের করায়েত্তে। গত কয়েক মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি তার প্রমান দিচ্ছে ।

প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে সংগতিপূর্ণ গ্রামীন কৃষি-কৃষ্টি হতে বিচ্ছিন্ন করে অসংগতিপূর্ণ কৃষিপ্রযুক্তি ও জটিল বিপণন ব্যবস্থা স্বাধীন কৃষককে কৃষিমজুরে পরিণত করেছে। কৃষিতে বর্জ্য বিষ প্রয়োগে, রাসায়নিক সার ব্যবহারে, যান্ত্রিকীকরণের জালে, লুটপাটের বিপনন ব্যবস্থায় আগামী দিনে চাষবাস ও চাষীদের ভবিষ্যৎ কি হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পরিবেশ প্রকৃতি এবং গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতি!

 

লেখক : কৃষিবিদ, কলাম লেখক ও ‘দেশিগাছ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আন্দোলন’ এর উদ্যোক্তা