পরিবেশ, বন ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০২৩ সালে “পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা” প্রণয়ন করা করেছে। বিধিমালার ৫ ধারায় অবস্থানগত ও পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের উদ্দেশ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের কার্যক্রমের ব্যপ্তি ও এ থেকে সৃষ্ট সম্ভাব্য দূষণের পরিধি, মাত্রা এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের উপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পসমুহকে ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল।
সবুজ শ্রেণিভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্প পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর তুলনামূলকভাবে খুব কম প্রভাব ফেলে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পসমুহের পরিবেশ প্রশমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। হলুদ শ্রেণিভুক্তগুলোর ক্ষেত্রে পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর মধ্যম মাত্রার প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাব পরিহার করার জন্য পরিবেশ দূষণ প্রশমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। কমলা শ্রেণিভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পসমুহের পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন এবং উপযুক্ত প্রশমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করা আবশ্যক। আর লাল শ্রেণিভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পসমুহের পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর তীব্র প্রভাব রয়েছে। যা পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত মাত্রায় পরিহার করা প্রয়োজন এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করবার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রশমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।
বিধিমালায় উল্লেখিত ধারা ১৬ অনুসারে লাল শ্রেণির কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তোকে পরিবেশগত প্রভাব নিরুপনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রকল্পের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। জনমত যাচাই কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে যথাসম্ভব সম্পৃক্ত করতে হবে। জনমত যাচাইয়ের সময় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য সুফল, পরিবেশহত প্রভাব, সামাজিক প্রভাব এবং এসকল প্রভাব প্রশমনের উপায়সমুহ উপস্থাপন করতে হবে। পরিবেশগত প্রভাব নিরূপন প্রতিবেদনসহ আবেদন করতে হবে। জনমত যাচাই সংক্রান্ত তথ্যাদি অধিদপ্তর ও উক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের ওয়েব সাইটে প্রচার করতে হবে।
২০২৩ সালে সংশোধিত “পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা” এর তফসিল-১এর কমলা শ্রেণির ৯৯ নম্বরে উল্লেখ করা রয়েছে “তামাক প্রক্রিয়াকরণ, জর্দ্দা প্রস্তুত, বিড়ি-সিগারেট কারখানা”। অথচ ১৯৯৭ সালের “পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা” এর তফসিল-১এর লাল শ্রেনীর ৫৩ নম্বরে ছিলো “তামাক (প্রক্রিয়াজাতকরণ/সিগারেট-বিড়ি প্রস্তুত)”। উল্লেখ্য ১৯৯৭ সালের তফসিল ১ এ উল্লেখিত পাদটিকা অনুসারে লাল শ্রেণির তালিকাভুক্ত কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানই আবাসিক এলাকায় স্থাপিত করা যাবে না। কিন্তু উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা গেছে যে, তামাকজাত দ্রব্যের মত স্বাস্থ্যহানীকর পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা লাল তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মহাখালীর মতো জনবহুল ও আবাসিক এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে কারখানা স্থাপন করে অবস্থান করছে। কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রতিনিয়ত জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। উল্লেখ্য বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় কয়েকবার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
তামাক উৎপাদন ও ব্যবহার পরিবেশের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা শুধু মানব স্বাস্থ্য নয়, প্রাণীকুলের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিকেও স্থায়ী ঝুকিঁর মধ্যে ফেলছে। এমন একটি ক্ষতিকর পণ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) প্রণয়নের পাশাপাশি সারা পৃথিবীতে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নানামুখী পদক্ষেপ। সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল (এসডিজি) এ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তামাক নিয়ন্ত্রণকে। বাংলাদেশেও তামাক নিয়ন্ত্রণে এফসিটিসি ও সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়ন, সারচার্জ আরোপ, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তকরণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের গাইড লাইন প্রণয়ন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গাইড লাইন প্রণয়ন ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের দেশের সরকার প্রধানের তামাক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শক্তিশালী কমিটমেন্ট। যা বিশ্বের দরবারে তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় ও ভাবমূর্তি উজ্জল করেছে।
ভাবনার বষিয় হলো ২০১৬ সালে প্রদত্ত ঘোষণায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সেখানে কোন কারণে ২০২৩ সালে এসে “পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা” সংশোধনের সময় তামাককে লাল শ্রেণি থেকে কমলা শ্রেণিতে নামিয়ে আনা হলো? তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কি তবে কমে গেলো? গবেষণা তো বলছে কোনভাবেই তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব কমেনি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এখানে কি তামাক কোম্পানির কোন সম্পৃক্ততা রয়েছে? এমনই উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৮ সালে যখন “কৃষি বিপনন আইন” এ তামাককে অর্থকরী ফসলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি দীর্ঘদিন ধরে সংশোধনের প্রক্রিয়ায় আটকে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিগুলো সুরক্ষায় গ্রহণ করা হচ্ছে না কোন সমন্বিত পদক্ষেপ ? এসকল সংকটে বড় হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। আমরা কি তবে তামাক নিয়ন্ত্রণে পিছনের দিকে হাটছি?
বর্তমানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছে মাননীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধূরী। বিগত দিনে তামাক নিয়ন্ত্রণে তার শক্তিশালী ও সোচ্চার ভূমিকা প্রশংসার দাবীদার। এ লেখনির মাধ্যমে প্রত্যাশা করছি পরিবেশ সংরক্ষন বিধিমালা ২০২৩ সংশোধন করে তামাকের মতো ক্ষতিকর পণ্যকে পুনরায় লাল তালিকাভুক্ত করা জরুরী।
সমস্যাগুলো খুব সুস্পষ্ট এবং চিহ্নিত। চিহ্নিত সমস্যাগুলো দূর করে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সংকট উত্তোরনের পথে হাটতে হবে। শুধুমাত্র তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেই দায়িত্ব শেষ নয়। যুগের সাথে সাথে আইন ও নীতিগুলোর উন্নয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতিগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। অন্যথায় তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতিগুলো কোম্পানির হস্তক্ষেপে তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা তৈরি করবে। অনতিবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে শক্তিশালী করার পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতিগুলো সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : সৈয়দা অনন্যা রহমান, হেড অব প্রোগ্রাম, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট