ঢাকাবুধবার , ৩১ মে ২০২৩
  • অন্যান্য

তামাক কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকি এবং একটি তামাক কর নীতির প্রয়োজনীয়তা

হামিদুল ইসলাম হিল্লোল
মে ৩১, ২০২৩ ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ । ৪৪১ জন

বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৭০ ভাগের কারণ অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের অন্যতম কারণ তামাক ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রতি ৫ টি মৃত্যুর ১ টির জন্য দায়ী তামাক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুসংখ্যা (বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজার) ম্যালেরিয়া, যক্ষা, এইচআইভি/এইডস, দুর্ঘটনার মৃত্যু এর সম্মিলিত মৃত্যুর চাইতেও বেশি এবং ৩ বছরে কোভিড মহামারীতে দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৫ গুণ।

২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখাযায় দেশে প্রায় ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগছে এবং প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের সংস্পর্শে আসার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ নতুন করে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ, আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও ক্যান্সার রিসার্চ-ইউকে এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক ব্যবহার জনিত রোগে চিকিৎসায় ব্যয় এবং কর্মক্ষমতা হ্রাসের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা অথচ একই সময়ে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় ২২ হাজার কোটি টাকা।

তামাক ব্যবহারজনিত রোগের কারণে আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে তামাক ব্যবহারজনিত রোগের চিকিৎসায় যার ভার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বহন করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর এই বোঝা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। এই ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মানুষকে তামাকের ব্যবহার থেকে দুরে রাখতে হবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা উপায়ের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে করারোপ সব চেয়ে সাশ্রয়ী এবং কার্যকর উপায় হিসেবে বিশ্বব্যাপি স্বীকৃত। কর বৃদ্ধির মাধমে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলে তামাক ব্যবহার কারীরা ব্যবহার কমিয়ে দেয় এবং অন্যরা তামাকের ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয়। বিশেষ করে তরুণ, কিশোর ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব ব্যপক।

অন্যদিকে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে করারোপে সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিএনটিটিপি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখাযায় স্টেন্ট/রিং লাগানো, এনজিওগ্রাম, বাইপাস সার্জারি এই তিন ধরণের চিকিৎসায় দেশে মোট সম্ভাব্য ব্যায় ৪০৯.৪৪ কোটি টাকা। তামাকজাত দ্রব্যের উপর যথার্থ কর আরোপ করা হলে যে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে তার মাত্র ৪.৪৫% দিয়ে দেশের সবার জন্য তিন ধরনের হৃদরোগের চিকিৎসা ফ্রি করে দেওয়া সম্ভব।

তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে করারোপে যেমন সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায় একইসাথে তামাকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত সময়কালে সিগারেটের দাম নিম্ন স্তরে প্রায় ৫ গুণ, মধ্যম স্তরে প্রায় সাড়ে ৩ গুন, উচ্চ স্তরে প্রায় ৪ গুন এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রায় আড়াই গুন বৃদ্ধি এবং একইসাথে কর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সময়কালে সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় সাড়ে ৪ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যাবহার ৮% কমেছে (প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ২০০৯ সালে ৪৩.৩% থেকে কমে ২০১৭ সালে ৩৫.৩% এ নেমে এসেছে)। কর বৃদ্ধির হার যদি মুদ্রাস্ফীতির সাথে সামঞ্চস্যপূর্ণভাবে হতো তাহলে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার আরো বেশি হ্রাস পেতো। মূলত তামাকের ব্যবজহার হ্রাস করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণের আর্ন্তাতিক দলিল ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) তে স্বাক্ষর ও এটি রেটিফাই করেছে। এফসিটিসির ৬ষ্ট অনুচ্ছেদে মূল্য বৃদ্ধি ও করারোপের মাধ্যমে এর ব্যবহার কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এই চুক্তির শর্তসমূহ প্রতিপালন বাংলাদেশের জন্য নৈতিক বাধ্যবাধকতা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮৷ (১) অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ে বলা হয়েছে, “জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।”

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমু্ক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি তামাকের উপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং সকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো একটি তামাক কর নীতির রূপরেখা প্রণয়ণ করেছে। এ নীতি প্রণয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী, আইন প্রণয়নকারী সদস্যবৃন্দ, সাংবাদিকসহ তামাক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) এর ওয়েবসাইটে প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধরণেরও মতামত নেয়া হয়েছে।

এই নীতির রূপরেখায় ধারাবাহিকভাবে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করারোপ ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ, কর আদায় পদ্ধতি ও পর্যবেক্ষণ, ট্রাকিং ও ট্রেসিং, কর ফাঁকি বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি, কোম্পানির আয়কর ও সিএসআর বিষয়ে নীতি, তামাকের অবৈধ বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, তামাক কর সংক্রান্ত প্রশাসনিক বিষয়াদিসহ তামাক করারোপ ও নীতি বাস্তবায়নের কর্মকৌশল, সংশোধন, জবাবদিহি ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে করণীয় সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে যুক্ত করা হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত দেশে একটি কার্যকর তামাক কর নীতি প্রণয়নের তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বিদ্যমান জটিল তামাক কর কাঠামো ও প্রশাসনিক নানা জটিলতার কারণে একদিকে সরকার যেমন কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বিপরীতে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

দেশে কোন কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি না থাকায় তামাক কোম্পানী নানা ধরণের অনৈতিক সুযোগ নিচ্ছে। তারা কৌশলে কর ফাঁকি ও অধিক মূল্যে দ্রব্য বিক্রির মাধ্যমে অযাচিতভাবে নিজের মুনাফা বাড়িয়ে নিচ্ছে এবং প্রাণঘাতি প্রণ্যের বানিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় তামাক কোম্পানিগুলোর কৌশলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে বাজারে সিগারেট বেশিদামে বিক্রি হচ্ছে। দেশের অন্য সকল প্যাকেটজাত পণ্য প্যাকেটে লেখা মূল্যে বিক্রি হলেও সিগারেট প্যাকেটে লেখা খুচরা মূল্যের চেয়ে স্তর ভেদে ৮% থেকে ২৪% পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ তারা কর পরিশোধ করছে প্যাকেটে লেখা মূল্যের ওপর। এভাবে তারা প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। অর্থাৎ সরকার ৫০০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। তামাক কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি খুচরা বিক্রেতার কাছে প্যাকেটে লেখা মূল্যে মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে। তাই খুচরা বিক্রেতাকে বাধ্য হয়ে তা প্যাকেটে লেখা খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বেচতে হয়।

আবার, প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার ১ মাস আগে থেকেই তামাক কোম্পানীগুলো কারসাজি করে সিগারেটের দাম বাড়িয়ে দেয় এবং বাজেটে নতুন দাম ঘোষণার পর ৪/৫ মাস তারা আগের বছরের সিগারেট (মজুদ করে রাখা) নতুন মূল্য অনুসারে (ওপরের বর্ণনা অনুসারে প্যাকেটে লেখা মূল্যে থেকে বর্ধিত মূল্যে) বিক্রি করে। কিন্তু কর পরিশোধ করে পুরানো দামের ওপর। এভাবেও তারা ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয়।

দেশে কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি নেই। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে দেশি ও বহুজাতিক তামাক কোম্পানীগুলো। একটি কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তামাক কর সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়কে নিয়মবদ্ধ করবে। যার ফলে তামাক কোম্পানী কর্তৃক এভাবে কর ফাঁকি দেওয়া বন্ধ হবে। পাশাপাশি একটি কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি বাংলাদেশে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখবে। এভাব সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০৪০ সালের মধ্যে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারবো বলে আমরা বিশ্বাস করি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর তামাক কর প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক।