রাতুলের বাবা ছিলেন এক সময়ের চঞ্চল, হাসিখুশি মানুষ। হঠাৎ করেই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তে লাগলেন। ক্ষুধা কমে গিয়েছিল, ওজনও কমছিল ধীরে ধীরে। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল—তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ রকম গল্প শুধু রাতুলের বাবার নয়, হাজারো পরিবারের। গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। প্রতিবছর দেশে ক্যান্সারের কারণে ১২ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। প্রতি লাখে নতুন করে ৫৩ জন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষকদের পরিচালিত জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রিতে এ তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলায় এ গবেষণা পরিচালিত হয়। ওয়েব-ভিত্তিক জাতীয় ক্যান্সার রেজিস্ট্রি সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে একই পরিবারের ওপর ফলো-আপ পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। সম্প্রতি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণার প্রধান, বিএসএমএমইউ-এর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এমডি খালেকুজ্জামান এই ফলাফল উপস্থাপন করেন।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার মধ্যে পুরুষদের জন্য হার ১১৮ জন এবং নারীদের জন্য ৯৬ জন। গবেষণায় ৪৬ হাজার ৬৩১টি পরিবারের মোট ২ লাখ ১ হাজার ৬৬৮ জন অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ৪৮.৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১.৬ শতাংশ নারী ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৮ ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৯২.৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে। ২.৪ শতাংশ রোগী ছিলেন ১৮ বছরের নিচে, আর ৫.১ শতাংশ রোগীর বয়স ছিল ৭৫ বছরের বেশি।
শীর্ষ পাঁচটি ক্যান্সারের মধ্যে রয়েছে স্তন ক্যান্সার (১৬.৮ শতাংশ), ঠোঁট ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার (৮.৪ শতাংশ), পাকস্থলীর ক্যান্সার (৭ শতাংশ), কণ্ঠনালীর ক্যান্সার (৭ শতাংশ) এবং জরায়ু ক্যান্সার (৫.১ শতাংশ)। নারী ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশ প্রজনন অঙ্গের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। এদের মধ্যে জরায়ু ক্যান্সারে ১১ শতাংশ, ডিম্বাশয়ে ৫ শতাংশ এবং গর্ভাশয়ে ৩ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন।
ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে অন্যান্য জটিল রোগও বিদ্যমান ছিল। ১৭ শতাংশ রোগী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন, ১১ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন, ৬ শতাংশ হৃদরোগে ভুগছিলেন, ৩ শতাংশ ক্রনিক কিডনি রোগী এবং ২ শতাংশ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গবেষণায় আরও জানা যায়, ৭৫.৮ শতাংশ পুরুষ ক্যান্সার রোগী ধূমপানের অভ্যাসযুক্ত ছিলেন। তবে ৪৬ শতাংশ ক্যান্সার রোগীর তামাক সেবনের ইতিহাস ছিল না।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী একাধিক চিকিৎসা যেমন অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপি নিয়েছেন। তবে ৭.৪ শতাংশ রোগী রোগ নির্ণয়ের পরও কোনো চিকিৎসা পাননি।
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪১১টি পরিবারের ৫৮ হাজার ৫৩৯ জন অংশগ্রহণকারীকে ফলো-আপ করা হয়েছে। নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া শীর্ষ তিনটি ক্যান্সার হলো ফুসফুসের ক্যান্সার (১৬.১ শতাংশ), যকৃতের ক্যান্সার (১২.৯ শতাংশ) এবং কণ্ঠনালীর ক্যান্সার (১২.৯ শতাংশ)।
গবেষকরা বলেছেন, দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি চালু রাখতে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা উচিত।