ধোঁয়াবিহীন তামাক অর্থাৎ জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খৈনিসহ বিভিন্ন ধরণের চর্বণযোগ্য তামাক ব্যবহার করে মানুষ ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছেন। বাংলাদেশের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে ২০১৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হলেও তামাকদ্রব্যের এই ধরন নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। জাতীয় পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ধুমপান নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন তামাক দ্রব্য যেমন ই-সিগারেট,ভ্যাপ ইত্যাদীর আগ্রাসন যতোটা উদ্বেগ সৃষ্টি করে জর্দা বা সাদাপাতা যেহেতু পানের সাথে খাওয়া হয় তাই এটা খাদ্যের অংশ হয়ে যায় এবং সামাজিক পরিবেশে গ্রহণযোগ্য ভাবেই খাওয়া যায়, লুকাতে হয়না। গুল ব্যবহারকারী অধিকাংশই গরিব নারী এবং পুরুষ । তাই এইসব তামাক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বিষয় নিয়ে নীতি নির্ধারকরা উদ্বিগ্ন নন। অথচ ধুমপায়ীদের চেয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবীর সংখ্যা বেশি। এই কথা তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) প্রায় সব সভাতেই তুলে ধরে এবং এর প্রতিকারের দাবি করে।
তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) সারাদেশেই নারী সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করে। আইনে যেহেতু এই সব ধোয়াবিহীন তামাকদ্রব্যের উল্লেখ আছে তাই তাঁরা বিষয়টি মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্ক রেখে গ্রামের উঠান বৈঠক ও নানা পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তামাক ব্যবহার ছাড়ানো বা cessation এর কাজ করছেন। এতে বেশ ভাল ফল পাওয়া গেছে।কারণ আইনে এখনো ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ন্ত্রণের ভাল কোন পদক্ষেপ নেই।গত ১৪ জুন,২০২৩ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তাবিনাজের একটি কর্মশালায় বিভিন্ন জেলার সদস্যরা গ্রামের নারিদের ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার ছাড়ানোর কাজের ফলাফল তুলে ধরেন। কাজটি তারা করেছিলেন ২০২১ সাল থেকে। প্রথমে তাদের সাথে পরিচিত হয়ে ধীরে ধীরে জর্দা-সাদাপাতা ছাড়ানোর কথা বলেন। এভাবে কাজ এখনও চলছে।
শারমিন কবীর বীনা,ঝুমকা বাংলাদেশ,জামালপুর,
হস্ত শিল্প নিয়ে পাঞ্জাবীতে এমব্রয়ডারি, নকশী কাঁথার এবং অন্যান্য হাতের যারা কাজ করে এমন গ্রুপের ২০ জন সদস্যদের জর্দা ব্যবহার ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।তারা পানের সাথে জর্দা সেবন করতো। তাদের সাথে সভা করে এই তামাক ব্যবহারের ক্ষতি এবং তামাকের ক্ষতির বিভিন্ন বিভৎস ছবি দেখিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করা হোত। এই বিভৎস ছবিগুলি তাদের মনে দাগ কেটেছে । এই ২০ জনের মধ্যে ১৮ জন জর্দা সেবন ছেড়ে দিয়েছেন।
জাহানারা বিউটি,নাটের,
নাটোর সদর উপজেলায় অনেক পরিবারে গরু পালন করে মিষ্টির দোকানে দুধ সরবরাহ করে। সেই পরিবারের ১০ জন নারী সদস্যকে নিয়ে জর্দা ব্যবহার ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। তাদের সাথে বিভিন্ন সময় আলোচনা সভা করা হয়েছে। এদের মধ্যে জর্দার ব্যবহার নেশার পর্যায়ে চলে গেছে। তাই ছাড়ানো বিষয়টি খুব কঠিন ছিল। প্রথমে ২ জন ছাড়লেও অন্যরা বিকল্প কিছু না পেলে ছাড়তে পারছিলনা। তাদের পরামর্শ দেয়া হয় গুয়ামুড়ি,চকলেট,কালিজিরা ইত্যাদী মুখরোচক খাদ্য খাওয়ার জন্য। এভাবে শেষ পর্যন্ত ১০ জনই জর্দা খাওয়া ছেড়েছেন।
লায়লা কানিজ,মাগুড়া
মাগুড়া জেলার শ্রীপুর উপজেলায় খামারপাড়া গ্রামে আদিবাসি গোষ্ঠি আছে। তারা এক সময় সবাই শুকর পালন করতো। এখনও কেউ কেউ শুকর পালন করে। আবার কেউ কেউ অন্যান্য ব্যবসা যেমন মুড়ি ভাজার কাজ করে। তাদের সাথে উঠান বৈঠক এবং আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে ১ জনকে তারপর ২ জন, ৩ জন করে আস্তে আস্তে সবাই জর্দা-সাদা পাতা খাওয়া ছেড়েছেন। তারা বলেছেন ‘আমরা আর খাবনা’। যখন নেশা লাগে তখন তাদের আমলকি,কালোজিরা ধনিয়া খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তামাকের ব্যবহারে স্বাস্থ্যক্ষতির ছবিগুলো দেখে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। অনেকে ভয় পেয়েছে। তারা বলেছেন ক্যান্সার এর মাহামারি থেকে বাঁচতে হলে আমাদের তামাক ছাড়তে হবে।
তাবিনাজের সমন্বক সাইদা আখতার বলেন, এই কাজটা যখন শুরু করি তখন তাবিনাজ সদস্যদের ২/৩ টি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ আলোচনার বিষয় ছিল এই গরিব নিরক্ষর নারীদের কিভাবে বোঝানো যায়। একটি প্রশিক্ষণে অধ্যাপক ডা.সোহেল রেজা চৌধুরী ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, অধ্যাপক ড. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ ক্যান্সর সোসাইটি এবং অধ্যাপক ডা.সামিনা চৌধুরী স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন যারা ছাড়তে চায় তাদের বিকল্প কিছু খেতে দিতে হবে।
ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার ছাড়ানো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। এখানে দুটি বিষয় খুব কাজে দিয়েছে। এক। সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে তামাকের ব্যবহারে স্বাস্থ্যক্ষতির ছবি; দুই যাদের নেশা হয়ে গেছে তাদের জন্যে বিকল্প যেমন কালোজিরা, চকলেট বা লজেন্স, আমলকি, ধনিয়া ইত্যাদী খাওয়ার পরামর্শ দেয়া।
তামাক ব্যবহারকারীরা তামাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরার কারনে এক ধরণের মানসিক অশান্তিতে ভোগেন। নেশা হয়ে গেলে তারা কিছু বুঝতে চাননা। তাই ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে আইনে শাস্তির বিধান রাখার চেয়ে বেশি কার্যকর হচ্ছে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং বিকল্প কিছু সরবরাহকরা।অন্যদিকে এসব তামাক দ্রব্যের উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীদের ওপর , খুচরা বিক্রির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।দাম বাড়িয়ে ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া। এই দ্রব্য যেন সহজলভ্য না হয় তার ব্যবস্থাকরা।