ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১১ এপ্রিল ২০২৪

পথে পথে মানুষের ঈদ আনন্দ

সুশান্ত সিনহা
এপ্রিল ১১, ২০২৪ ৩:২৬ অপরাহ্ণ । ৯২৯ জন

নতুন জিন্স প্যান্ট আর লাল রঙ্গের শার্ট পড়ে ছোট্ট দুই শিশু বেরিয়েছে। গলির মুখে দেখা; ছোটটির বয়স বছর ছয়। হাতে প্লাস্টিকের বন্দুক নিয়ে সে কী উচ্ছ্বাস তার । ঈদ আনন্দে খেলনাটা কখনও হাতে রাখছে কখনওবা জিন্স প্যান্টের পকেটে রাখার চেষ্টা। একটু দুরে দাঁড়ানো বাবা পান চিবাতে চিবাতে, বড় ছেলেকে বলছে ছোটটার হাত ধরে রাখতে। বড়টার বয়স বছর ১১ হবে, বাবার লুঙ্গিটাও কড়কড়ে রঙ্গীন, ঈদের দিন পড়বে বলেই হয়তো তখনও মাড় ভাঙ্গেনি লুঙ্গির।

খানিকটা এগুতেই দেখি নতুন ড্রেস পড়ে লাল টুকটুকে নতুন জমা পড়া মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে মা, তারও গায়ে রঙ্গীন নতুন জমা-হাতে বাটন ফোন ও পার্স। দুটোরই দাম হয়তো আহামরি কিছু না। কিন্তু শ্রমজীবী মায়ের কাছে অনেক দামি। কারণ সামান্য রোজগারের মধ্যেই ঈদের আনন্দের সাধ ও সাধ্যের হিসাব মেলাতে হবে। ঈদের খুশির আভা ছিলো শিশুটির মুখে। আরও খানিকটা পথ এগুতে দেখি হাতিরঝিলের মুখে বছর চারেকের মেয়ে আর বছর ১০/১১ বছরে ছেলের সাথে নতুন জামা পড়ে সেলফি তুলছিলো শ্রমজীবী বাবা। সাধারণ স্মার্ট ফোনেও ছবি তোলার অনাবিল খুশি ছড়িয়ে ছিলো বাচ্চা দুটোর চোখে মুখে; যেনো সত্যিকারের ঈদের চাঁদ পেয়েছে ওরা।

রং লেগেছিলো দুই ছেলে হাত ধরে হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা চকচকে লুঙ্গি পরিহিত আরেক বাবার সাথে থাকা শিশুদের। ছেলেরা নতুন পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা পড়ে হাঁটছে আনন্দে। হাঁটার মধ্যেও সেকি উল্লাস বাবার হাত ধরে, অপেক্ষা হয়তো সামনে দোকানে কিনবে কিছু খেলনা, হয়তো কিনে খাবে একটু আইসক্রীম। শিশুদের খেলনা ও খাবারের বায়না মেটাতে সকাল সকাল হাতিরঝিলে এসেছে ২/১ টি ভাসমান খাবার ও খেলনাওয়ালা। দুপুরের পর থেকে লোকে লোকারণ্য হবে পুরো হাতিরঝিল, রঙ্গীন পোশাকের রঙে রাঙিয়ে উঠবে ঢাকার ফুসফুস আখ্যা পাওয়া হাতিরঝিল।

পাগলা মাজারের গলির সামনে খানিক দূরে হাতিরঝিলের ফাঁকা রাস্তায় তিন কিশোরের সেলফি তোলার ঢং তো এখনো চোখে ভাসছে। বিশেষ করে সোনালী রঙ করা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার সে কী কসরৎ! বয়সটা প্রেমের তাই হয়তো একটু স্ট্যাইলিশ ছবি তোলার চেষ্টা। তারাও পড়েছে স্বাধ্যমতো টাকায় কেনা পাঞ্জাবী-পায়জামা। উল্টো দিকে গলির মুখে বেশ ১৩/১৪ কিশোরের জটলা, সাথে দুটো মোটর সাইকেলে পর্যায়ক্রমে চড়ার আনন্দে বেশ মশগুল কিশোররা। ওদের ছবিতো দেখতে দেখতেই দেখি মনের আনন্দে বছর তিনেকের মেয়ের হাত ধরে নেচে নেচে চলছে আরেক বাবা। নতুন পোশাক পড়া ফুটপাতে বাবা-বেটির এমন হন্টননৃত্য দেখে চোখ ফেরাতে পারলাম না। কিন্তু উপায় নেই থমকে যাবার, অফিসের পথে এগিয়ে এফডিসির সিগানলে দেখি হাঁটছে চার শিশু। আলাদা রঙ্গের নতুন প্যান্ট ও জমা পড়ালেও সবাই পড়েছে সাদা রঙের কেডস, ঈদের আনন্দের ছাপ ছিলে ওদের পায়ে পায়ে চলার ছন্দে, গন্তব্য হয়তো বা এফডিসি বা কারওয়ান বাজার চত্বরে।

এগিয়ে কারওয়ান বাজার রেলগেট পার হতেই দেখি সোনারগাঁও হোটেলের পাশের ফুটপাথে ঘুমিয়ে আছে দুই পথশিশু-কিশোর। একজনের পায়ের কাছে স্যান্ডালটা জোড়া ফেরত দিয়ে খালি পায়ে মলিন পোশাকে গটগট করে এগিয়ে গেল মানসিক ভারসাম্যহীন এক কিশোরী। হয়তো ঘুমিয়ে থাকা কিশোর স্যান্ডাল জোড়া নিজের পা গলিয়ে চলতে শুরু করেছিলো। একটু পরেই মনে হয়েছে অন্যের জিনিস নেয়া ঠিক নয়, তাই হয়তো স্যান্ডেল জোড়া রেখে গেলো ঘুমন্ত পথশিশুর পায়ের কাছে। কী দারুণ, মানসিক ভারসাম্য নেই কিন্তু মানুষতো, পাগল হলেও বিবেক তো আছে!

ভাবতে ভাবতে সার্ক ফোয়ারা পেরিয়ে অফিসের সামনে। ভবনে উঠতেই দেখি অফিসের ভবনের নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য নিয়মিত খাবার দিতে আসা বাবার সাথে বছর দশকের মেয়েটিও পড়ে এসেছে লাল রঙ্গের জামা; উজ্জ্বল জামায় সোনালী জড়ির মতো চোখে মুখে উৎচ্ছ্বাস ছিলো শিশুটির মুখে। নিরাপত্তাকর্মীদের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় ও সামান্য সালামী দিয়ে অফিসে এসে সহকর্মীদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়। দু’একজন সহকর্মী সাথে এনেছেন সন্তানদের অফিসে। সাথে চলছে মানুষের ঈদ উদযাপনের নানান সংবাদের কর্মযজ্ঞ একাত্তর টেলিভিশনের শাখা অফিসে। আমাদের মতোই একাত্তরসহ অন্যান্য টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমে অনেক কর্মীরা অফিস করছেন ঈদে, যেমন প্রতিবছরের মতো ঈদে ছুটি পায়নি পুলিশসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, চিকিৎসক, ফায়ার সার্ভিসসহ জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ঈদের দিন সকালে বাসা থেকে অফিসে আসার পথে পথে শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের নিয়ে ঈদ আনন্দের অনাবিল সৌন্দর্যে মুগ্ধ। মনটা খারাপ হলো টেলিভিশনের স্ক্রীনে তাকিয়ে; কারণ ঈদ আনন্দ নেই গাজার শিশুদের মাঝে, ঈদের দিনে প্রাণ গেছে শিশুসহ ১২২ জনের। তারপরও জীবন থেকে না।

বি. দ্র. ঈদের আনন্দে আমাদের ঘরের হাঁড়ির খবরটুকু ফাঁস না করলে বেমানান হয় বটে! সকাল থেকে ভুতু ও বাহুবলীর সে কী উচ্ছ্বাস আজকে ঘুরতে যাবে তাদের মায়ের সাথে, পাবে সালামী। মুশকিল হলো বাহুবলীর ভীষণ লজ্জা সবার সামনে সালাম করতে, তাই একে একে মা, বাবা ও ভুতুকে আলাদা ঘরে ডেকে দরজা বন্ধ করে সালাম করে নিল সালামী । ভুতু প্রথমে ২০ টাকা সালামী দিলে বাহুবলী ফেরত দেয়ার শর্তে বলে ‘একছো টাকা দাও’ ‘একছো টাকা দাও’। আমাদের অনুরোধে ভুতু একশো টাকা দিয়ে বিশ টাকা চাইলেও তা আর ফেরত দেয়নি দস্যি ছেলে বাহুবলী মানে আমাদের প্রাঙ্গণ পথিকৃৎ।

বাড়তি ২০ টাকা খসাতে পেরে উচ্ছ্বাসে দৌড়ে টাকাগুলো নিয়ে ঢুকিয়ে রাখলো দেওয়াল ঘড়ি মার্কা একটা বড় প্যাকেটে, খাটের তলায়। ওটাই নাকি ওর টাকা জমানোর বাক্স। পরে ভুতু মানে আমাদের প্রজন্ম প্রকৃতি প্রাশ্নিক নিজের টাকা গুণে গুছিয়ে রাখলো তার মায়ের ব্যবহৃত মানি ব্যাগে। … সন্তানদের হাসিখুশির চেয়ে বড় কোনো পাওয়া নেই বাবা মায়ের। যা হোক শ্রমজীবী, হোক কর্মজীবী, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত।

ঈদের এই উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার ঘরে, সবার মাঝে, ভালো থাকুক সবাই। মাত্র ২ দিন পরে আবারও রঙ্গীন সাজে সেজে উঠবে দেশের সবচেয়ে বড় সার্বজনীন উৎসবের পহেলা বৈশাখের আনন্দে। আনন্দে বাঁচি সকলে, হানাহানি-সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে জেগে উঠি সকলে।

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, একাত্তর টেলিভিশন
sinhasmp@yahoo.com