ঢাকাশনিবার , ১৫ জুন ২০২৪
  • অন্যান্য

আজকের সর্বশেষ সবখবর

পরিবেশ ও পাখির আবাসে তেঁতুল গাছের গুরুত্ব

রতন মণ্ডল
জুন ১৫, ২০২৪ ১২:৩৩ অপরাহ্ণ । ১৭৪ জন

তেঁতুল এর কথা মনে আসলেই যেমন জীভে জল বা লালা রস চলে আসে, তেমনি একে ঘিরে আমাদের বাংলা সমাজে আছে নানা রকম রসাত্বক কাহিনী, আলোচনা-সমালোচনা। গ্রামে বেড়ে ওঠা সকলেরই তেঁতুল খাওয়া, লোভ দেখানো, অন্যের মুখে লালা ঝড়ানো বিশেষ করে তরুণীদের খেপানোর মতো আছে মজার স্মৃতি।

আমি দেখেছি আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর তীরে প্রকাণ্ড এক তেঁতুল গাছে ধরত প্রচুর তেঁতুল। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ঝড়ো বাতাস হলেই পাকা তেঁতুলের ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে সমস্ত গাছ। ছুটে যেতাম তেঁতুল কুড়াতে। মাঠে গিয়ে কাঁচা, গাবা (আধাপাকা), পাকা তেঁতুল খেতাম।  গাবা তেঁতুল খেতে বেশি সুস্বাদু। কখনো লবণ, শুকনো পোড়া মরিচ, চিনি মিশিয়ে টক-ঝাল-মিষ্টি চাটনী বানিয়ে খেতাম।

শুধু কি তাই কচি পাতা, তেঁতুলের বিচি ভেজেও খেতাম। আবার আমাদের মাঠের মাঝে বড় পুকুর পাড়ে ছিল আর এক প্রকাণ্ড গাছ। সেই গাছের নামেই মাঠের নাম তেঁতুল-তলীর মাঠ। গাছদুটির বয়স গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ ব্যক্তিও বলতে পারত না।  ধারণা করা হতো দেড়-দুশো বছর হবে। আজ সেই প্রকাণ্ড গাছদুটি নেই। মাঝারি আকারের গাছও কেটে সাবার।

প্রাচীন কাল থেকে এই বাংলা জুড়ে ছিল এর বিস্তৃতি।  তেঁতুল গাাছের বৈজ্ঞানিক নাম Tamarindus indica এর প্রজাতি নামে indica শব্দটি ভারতবর্ষে অতি প্রাচীনকাল থেকেই জন্মে থাকে বলে নির্দেশ করে। অনেকে আবার তেঁতুলের আদিবাস গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আফ্রিকান সাব-সাহারানে বলে মনে করে। যাইহোক পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত Fabaceae পরিবারের চিরহরিৎ এই গাছ বাংলার পরিবেশ প্রকৃতির সাথে পরিপূর্ণভাবে শুধু মিশেই যায়নি, একে ঘিরে আবাস তৈরীতে হরেক প্রকার পাকপাখালির প্রথম পছন্দ।

প্রচুর শাখা-প্রশাখা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘন পাতা বিশিষ্ট গাছ।  বছরের পর বছর বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে। ফলে শতশত পাখি আবাস গড়তে উপযোগী বলে নীড় তৈরী করে। বিশেষ করে বাদুড়-বক-শামুকখোল পাখিদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ এই গাছ। আমাদের এলাকায় (আক্কেলপুর উপজেলায় গোপীনাথপুর, জয়পুরহাট সদরে তেঘর বিশা গ্রামসহ) যে কয়টিস্থানে বাদুর কলনী দেখেছি সবকটিতেই প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছকে ঘিরে তাদের অবস্থান। এই বাদুর আবস্থানকে কেন্দ্র করে এইসব পাড়া ব্যকদুর তলা নামে (বাদুর তলাকে আঞ্চলিক ব্যকদুর তলা বলে) পরিচিত।  আর বহুসংখ্যক বক ও শামুকখোল পাখি যেসব জায়গায় আবাস গড়ে তুলেছে (অভয়াশ্রম) আমার দেখা সবখানেই বেশকিছু বড় বড় তেঁতুলগাছ আছে।

ছোট বেলায় দেখেছি গ্রামে প্রচুর বক বাসা বাঁধত তেঁতুলগাছকে কেন্দ্র করে। বর্ষা মৌসুমে তাদের ছানাদের খাওয়াতে বিলঝিল হতে যে মাছ ধরে আনত তার কিছু কিছু গাছের নিচে পরেও যেতো।

আজ সেসব তেঁতুল গাছ নেই, সেইসাথে বকপাখিও নেই। নিরাপদ আশ্রয়হীন পাখিসব তাদের ডিম পেড়ে, তা থেকে বাচ্চা জন্মদিতে না পাড়ায় তাদের সংখ্যাও ব্যাপকহারে কমে গেছে। আকাশে একসময় সাদা-সাদা বক একসাথে সাড়ি হয়ে অনেক উচু দিয়ে উড়ে যেত।  দূর হতে মনে হতো যেন একটি বিরাট রশি বা শাড়ির আঁচল উড়ে যাচ্ছে।  আজ আর তা চোখে পড়ে না।  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গতির উপাসক রূপে কবি-মনের সেই গতির সুরই সুস্পষ্ট হয়ে ফুটেছে বিখ্যাত ‘বলাকা’ কাব্যে।

তাই কবি গেয়েছেন- ‘হে হংস বলাকা, আজ রাত্রে মোর কাছে- খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা’। সেই গতি ও মুক্তির প্রতিকী অর্থে বাংলাদেশের বিমানের লগো বলাকা এবং কার্যালয়ের নাম রাখা হয়েছে বলাকা ভবন। আর সেই বলাকাকে হত্যা করে, আবাস ধ্বংস করে, আহার কেড়ে নিয়ে আজ বিলুপ্তির মুখে।

তেঁতুল গাছে শুধু বাদুর বক শামুকখোল পাখিই আবাস গড়ে না। পানকৌড়ি, রাতচোড়া, বালিহাঁস, ভাত শালিক, গোবরে শালিক, শ্যামা বুলবুলিসহ প্রায় সব পাখিরই পছন্দের এই গাছ। আবাস তথা নিরাপদ প্রজননস্থল সংকটে পাখির সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ তা বলা যায়।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস ২০২০’ শীর্ষক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে দেশের সবথেকে বেশি দেখা পাওয়া পাখিদের সংখ্যা কমেছে ৮০% হারে। আবার বিজ্ঞান ও জীব সংরক্ষণ জার্নালে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়- অ্যামেরিকা ও কানাডায় গত ৫০ বছরে পাখির সংখ্যা কমেছে ৩ বিলিয়ন।

বাংলাদেশে পাখির সংখ্যা হ্রাসের দেশজুড়ে গবেষণা বা ব্যাপক সমীক্ষা জানা না গেলেও, আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) কর্তৃক প্রকাশিত লাল তালিকায় জানা যায়, ২০০০-এর আইইউসিএন রেড লিস্টে ১৩ টি প্রজাতি দেশ থেকে বিলুপ্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা ২০১৫ সালে অন্য সমস্ত প্রজাতির সাথে পুনরায় মূল্যায়ন করে ৩১ টি প্রজাতি দেশ থেকে বিলুপ্ত হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, পাখির সংখ্যা কতটা আশঙ্কাজনহারে কমে যাচ্ছে।

অথচ পাখিরা পরিবেশ তথা কৃষির জন্য কতটা আর্শিবাদ তা অনুমান করা কঠিন। পাখিরা তাদের প্রোটিনের প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ কীট-পতঙ্গ খেয়েই মেটায়। ‘দ্য সায়েন্স অব ন্যাচার’ জার্নালে জুলাই, ২০১৮ মাসে প্রকাশিত গষেণা প্রতিবদনে বলা হয় বিভিন্ন ধরনের পাখি বিশ্বে বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি মেট্রিকটন ক্ষতিকর পোকামাকড় খায়।

সুইজারল্যান্ডের ব্রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক একটি গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১০৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে তারা এ সংখ্যা হিসাব করেছেন। এতে আরো বলা হয়, বনে থাকা পাখিরা ৭০ শতাংশ পোকামাকড় খেয়ে ফেলে। যা মোট হিসাব করলে প্রতিবছর ৩০ কোটির মতো দাঁড়ায়।

পাখিদের আবাসের উপযোগী তেঁতুল গাছ সাবার করে ফেলায় তাদেরও পরোক্ষভাবে বিলুপ্ত ঘটিয়েছি আমরা। প্রতিবছর দেশে লক্ষ লক্ষ তেঁতুলগাছ সামান্য প্রয়োজনে কেটে ফেলি কিন্তু কেউ এ গাছ রোপন করে না। কোরবানী ঈদের সময় মাংস কাটার অন্যতম উপকরণ গাছের ছোট ছোট গুড়ি বা খাট্টা বা ডুমের কথা আসলেই তেঁতুল গাছ কাটার কথা আসে।

হ্যাঁ, অনেকেই জানেন তেঁতুল গাছ কেটে এসব খাট্টা তৈরী করা হয়। তবে বেল গাছের খাট্টাও অনেকসময় ব্যবহার হয়, কিন্তু তা সংখ্যায় খুবকম। তেঁতুল গাছের তন্তু বেশ শক্ত এবং কাঠ অন্য গাছের মতো কটু-গন্ধযুক্ত নয় বলে এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এক সময় ইট পোড়ানোর ক্ষেত্রে এরচাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য গাছের চেয়ে ১০-১২ শতাংশ বেশি মূল্যে ক্রয় করে কর্তন করত। কারণ এ গাছের কাঠ বেশিক্ষণ জ্বলে এবং আগুনের তাপও তীব্র। ফলে একসময় বাংলার মাঠে ঘাটে নদীর তীর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড যেসব তেঁতুল গাছ ছিল তা সবই আজ বিলুপ্ত। ছোট মাঝারি গাছও বিলুপ্তির পথে। এবছর ২০২৪ সালে দেশজুড়ে কোরবানী পশুর সংখ্যা ১ কোটি ৭ লাখ।  সেই হিসাবে একদিনের জন্য গাছ কেটে খাট্টার চাহিদা পূরণ করতে লক্ষাধিক গাছ কর্তন করা হচ্ছে। অথচ একটি তেঁতুল গাছও রোপণের উদ্যোাগ নেই।

তেঁতুলগাছ শুধু পাখির আবাসের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর আছে বেশকিছু ঔষধি গুণাগুণ।  বদহজম, পেটের বায়ু, হাত-পা জ্বালা-পোড়ায় তেঁতুলের শরবত বেশ উপকারী। ছোটবেলায় দেখেছি ছাগল বা গরুর বদহজমজনিত কারণে পেটে গ্যাস হলে তেঁতুল গুলিয়ে শরবত করে খাওয়াত। তেঁতুলের কচি পাতা সেদ্ধ করে ঠান্ডা করে খেলে সর্দি ভালো হয়। তেঁতুল হজমে সহায়তা করে, মাথাব্যথা দূর হয়। ধুতরা, কচুর ও অ্যালকোহলের বিষাক্ততা নিরাময় করে। গাছের ছাল চুর্ণ ব্যবহারে দাঁত ব্যথা, চোখ জ্বালা-পোড়া নিরাময়, শরীরের ওজন ও উচ্চ রক্তচাপ কমায়। আচার চাটনি, চকলেট ও অন্যান্য ভেষজ কাজে তেঁতুল ব্যবহূত হয়। ফুচকা খেতে তেঁতুলের টক ছাড়া তো অসম্ভব। অনেক এলাকায় তেঁতুলের চা খাওয়া বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। তেঁতুলে প্রচুর শর্করা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি রয়েছে।  তেঁতুলে টারটারিক অ্যাসিড থাকায় স্বাদ টক হয়। বীজ বিভিন্ন নকশীশিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাকা ফল শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। দেশে প্রকৃতিকভাবে সার বিষ ছাড়া উৎপাদন হলেও পাকা তেঁতুল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে গ্রামের হাটবাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। সূতরাং এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়।

তাছাড়া তেঁতুল গাছে ফুল ফোটার মৌসুম জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস। এ সময় অন্যান্য গাছগাছালির ফুল কম হয়। ফলে মৌমাছি প্রজাপতি সহ অন্যান্য পতঙ্গের মধু পরাগ সংগ্রহে খুব কাজে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো মূল্যায়ণ করে পরিবেশ উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সেনেগাল, দক্ষিণ সুদানসহ পশ্চিম আফ্রিকায় তেঁতুল গাছ রোপন ও বিতরণের দীর্ঘ পরিকল্পনার পরামর্শ প্রদান করেছে সেখানের বিশেষজ্ঞরা।

পরিবেশ উন্নয়নে ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তেঁতুল গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশের সাথে তেঁতুল উৎপাদনে অর্থনৈতিতে বেশ বড়রকমের সহয়তা করে। আমাদের হাজার হাজার নদীর তীরে, বিল-ঝিল দীঘির পাড়ে সুপরিকলপ্না করে প্রচুর এই গাছ রোপন করা জরুরী। বিশেষকরে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে এর বিকল্প নেই। তাই পাখির নিরাপদ আবাস গড়তে পাখি প্রেমী  ও পরিবেশকর্মীদের তেঁতুল গাছ রোপনে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগসহ  সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত।

রতন মণ্ডল : কৃষিবিদ, কলাম লেখক ও ‘দেশীগাছ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আন্দোলন’ এর উদ্যোক্তা।