লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগ নির্মূলে বাংলাদেশের সফলতা অর্জন করেছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। মানুষ জানতে পেরেছে প্রতিকূল পরিবেশ এবং জীবাণু বা পরজীবীর কারনে মানবদেহে অনেক ধরনের সংক্রামক ব্যাধি বা রোগ হয়ে থাকে। উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলিতে অবহেলিত কিছু সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। এই সকল রোগ গুলিকে পাশ্চাত্য ভাষায় Neglected Tropical Disease (NTD) বলা হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবেচনায় সারাবিশ্বে ২১টি NTD চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সকল সংক্রামক রোগের মধ্যে কিছু সংখ্যক রোগ উপউষ্ণমন্ডলীয় দেশ গুলোতেও বিরাজিত । যেমন, বাংলাদেশ একটি উপ-উষ্ণমন্ডলীয় দেশ যাতে বর্তমানে ৭টি NTD বিদ্যমান আছে। বাংলাদেশ সরকার এই ৭টি NTD নির্মূল অথবা নিয়ন্ত্রণে অবিচল কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতার ফসল হিসাবে বিদ্যমান লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস নামক NTD নির্মূলে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি সফলতা অর্জন করেছে।
লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস নির্মূলে কার্যক্রমটি বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি কর্মসূচীর মাধ্যমে ২০০১ সাল থেকে চলে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতায় এই কার্যক্রমটি শুরু হয়। সরকারের পাশাপাশি পরবর্তীতে বিভিন্ন দাতা সংস্থা সমূহ যেমন, World Health Organization (WHO), FHI 360, LSTM-CNTD, JICA, RTI International-USAID, ASCEND ও অন্যান্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক অনুদানে কার্যক্রমটি চলে আসছে।
২০০১ সালে বাংলাদেশে একটি জরীপের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে, ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৯টি জেলায় ফাইলেরিয়া রোগের সংক্রমনের (রক্তে মাইক্রো ফাইলেরিয়ার উপস্থিতি) হার সর্বোচ্চ ২০% ছিল।
এই ১৯টি জেলা হলো: পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা। এই সকল জেলাসমূহে ২০০১ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী বছরে একবার করে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ৫ বছর সার্বিক জনগোষ্ঠিকে গণ-ঔষধ সেবন করানো হয়। দেখা যায় যে, ২০১৫ সাল পর্যন্তরোগটির সংক্রমনতার হারের উপর ভিত্তি করে জেলা ভেদে ৫ থেকে ১২ রাউন্ড গণ-ঔষধ সেবন করানো হয়। ২০১৫ সালে সার্বিক বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী ফাইলেরিয়াসিস এর জন্য গণ-ঔষধ সেবন কার্যক্রমটি বন্ধ করা হয়।
২০১১ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবেচনায় ও সহযোগীতার সংক্রমনতার বাধাগ্রস্থতার জরীপ (Transmition Assessment Survey ev TAS) কার্যক্রম শুরু করা হয়। নিয়মানুযায়ী ১৯টি ফাইলেরিয়া আক্রান্ত জেলায় পর্যায়ক্রমে ২০২২ সাল পর্যন্ত৩টি অঝ সম্পন্ন করা হয়। সংক্রমনতার হার (রক্তে মাইক্রো ফাইলেরিয়ার উপস্থিতি ১% এর নীচে) নিয়ন্ত্রিত থাকায় ২০২২ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিকট এতদসংক্রান্ত একটি পুঞ্জিভূত দলিল (Dossier) দাখিল করা হয়। পুঞ্জিভূত দলিলটির (Dossier) সার্বিক মূল্যায়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি ৫ই মে ২০২৩ সালে বাংলাদেশকে ফাইলেরিয়ামুক্ত বা নির্মূল ঘোষণা করে। যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অন্যান্য দাতা সংস্থার সহযোগীতায় এই সফলতা অর্জন উদযাপন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। বলা বাহুল্য যে, বিশ্বে বাংলাদেশ এই সাফল্যের ১৮তম দেশ এবং এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ৪র্থ দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ফাইলেরিয়াসিস নির্মূলের যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে তা আগামী দিনগুলিতে টেকসই করার লক্ষে সুনিপুণ কর্মপদ্ধতি অব্যাহত রাখতে হবে। যার প্রয়াস হিসাবে সার্বিক জনগোষ্ঠিকে রোগটির সংক্রমনতার নজরদারীতে (Post-validation surveillance) রাখা প্রয়োজন। উপরোন্ত ফাইলেরিয়া রোগের কারণে যে সব রোগী অঙ্গ ফোলা (Lymphedema) ও বিকলাঙ্গতায় ভুগছে বিশেষ করে পুরুষ রোগীদের যাদের অন্ডকোষ ফুলে (Hydrocele) আছে তাদের জীবীকার/ কর্মক্ষমতার স্বার্থে অর্থনৈতিক কর্মময় জীবনে ফিরে আনার জন্য Morbidity Management & Disability Prevention (MMDP) কার্যক্রমের উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আগামী দিনগুলোতে সকলের সার্বিক সহযোগীতা একান্ত কাম্য।