ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৪ এপ্রিল ২০২৪
  • অন্যান্য

বিলুপ্তপ্রায় বরুণ বৃক্ষের রাজসিক সৌন্দর্য

রতন মণ্ডল
এপ্রিল ৪, ২০২৪ ৭:০১ পূর্বাহ্ণ । ৪০২ জন

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ কবিতায় পৃথিবীর সবচেয়ে ‘সুন্দর ও করুণ’ জায়গাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন ‘সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;/সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;/সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;/সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, – সেখানে বরুণ’–।

বসন্তের শেষভাগে পলাশ শিমুল ফুলের শোভা যখন সীমিত হয়ে আসে তখনই বরুণের গাছভরা সাদা ও হালকা হলুদ রঙের অফুরন্ত প্রস্ফুটন প্রকৃতিতে এক অনাবিল উচ্ছ্বাস এনে দেয়। সবুজ কচি পাতা ছাপিয়ে উপচে পড়া নয়নাভিরাম মৃদু সুগন্ধিমাখা ফুলের সৌন্দর্যে যে চোখ আটকে যাবে।

বহুবর্ষজীবী ১০ থেকে ১৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট, শাখা-প্রশাখা লেন্টিসেলযুক্ত, বাকল ধূসর-বাদামি ও মসৃণ। পাতা তিন ফলকযুক্ত। পুষ্পবিন্যাস করিম্ব, ফুলের পাঁপড়ি সাদা, পুংকেশর ২০টির বেশি। ফুল হালকা সুগন্ধযুক্ত। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার, শক্ত, হলদে ধূসর। প্রাকৃতিকভাবেই শিকড় থেকে গজানো চারা ও বীজে এর বংশবিস্তার হয়।

Capparaceae পরিবারভুক্ত এ উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Crateva Religiosa. এটি বৈন্যা শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, মহাকপিথা ও মারুতাপহ নামেও পরিচিত। প্রচলিত ইংরেজি নাম Spider Tree, Temple Plant, Garlic Pear। এর আদি আবাস ভারত, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। বাংলাদেশের জলাভূমি, নিচু এলাকা, নদীর তীর ও হাওর এলাকায় বেশি দেখা যায় বরুণ। উত্তরাঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না। বহুবর্ষজীবী এ উদ্ভিদ গ্রামে সাধারণ জ্বালানি কাঠ ছাড়া আর কোনো কিছুতেই ব্যবহার করা হয় না। তাই গাছটি রোপণে মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে।

গত ২৯ মার্চ জয়পুরহাট আক্কেলপুর সড়কে জামালগঞ্জে চিড়ি নদীর তীরে ব্রীজের কোল ঘেষে সবুজ কচি পাতা ছাপিয়ে গাছভর্তি থোকা থোকা সাদা-হলদে পাপড়ির অজস্র ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ছবি না তুলে পারলাম না। পরে সামাজিক মাধ্যমের গ্রুপে পোস্টের মাধ্যমেও খোঁজ নিয়ে জানতে পারি- এই বৃক্ষ জয়পুরহাটে আর কোথাও নেই। অর্থাৎ জয়পুরহাটে এটিই একমাত্র বরুণ গাছ। তাই “দেশীগাছ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আন্দোলন” এর পক্ষ থেকে এই বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষটি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকলকে আহবান জানাচ্ছি।

বসন্তে পাতা ঝরে গেলে গ্রীষ্মের শুরুতে নতুন পাতার সঙ্গে বড় বড় থোকায় ফুল আসে। মাসখানেক থাকে এই ফুল। বর্ষাকালে দেখা যায় কদবেলের মতো ছোট ছোট ফল। প্রাকৃতিকভাবেই শিকড় থেকে গজানো চারা ও বীজে এর বংশবিস্তার হয়।

একসময় মানুষ প্রাকৃতিকভাবে ফল পাকাতে বরুণের পাতা ব্যবহার করতেন। এখন অনেকে ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইট ব্যবহার করে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

প্রাচীনকাল থেকে বরুণ ভেষজ গাছ হিসেবে পরিচিত। এর পাতা অগ্নিমান্দ্য, চর্মরোগ, চক্ষু রোগ, ব্যথা, রসবাত নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। শিকড়ের বাকলের নির্যাস গ্যাস্ট্রিক রোগে ব্যবহার করা হয়। গ্রামবাংলায় বরুণের কাঁচা ফল রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়ার চলও আছে।

রতন মণ্ডল : কৃষিবিদ, কলাম লেখক ও ‘দেশীগাছ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আন্দোলন’ এর উদ্যোক্তা।