ঢাকাবুধবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • অন্যান্য

বিশ্বব্যাপী গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

রঞ্জন দে
ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫ ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ । ৬০ জন

বিশ্বব্যাপী গ্যাসোলিনের দাম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। গড় হিসাবে, এক লিটার গ্যাসোলিনের মূল্য ১.২৫ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন হতে পারে। এই পার্থক্যের কারণ হিসেবে মূলত কর, ভর্তুকি, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কাজ করে।

উন্নত দেশগুলোতে জ্বালানি করের হার বেশি থাকায় গ্যাসোলিনের মূল্য তুলনামূলক বেশি হয়। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যেমন নরওয়ে, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে গ্যাসোলিনের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, কারণ সেখানে পরিবেশগত নীতি কঠোর এবং সরকার করের হার বেশি রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নরওয়েতে প্রতি লিটার গ্যাসোলিনের দাম ছিল ২.৮৯ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে, তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে সরকারের ভর্তুকির কারণে জ্বালানির মূল্য তুলনামূলকভাবে কম থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ভেনেজুয়েলায় গ্যাসোলিনের দাম মাত্র ০.০২ মার্কিন ডলার প্রতি লিটার, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বিশ্বব্যাপী গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এটি পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি করে, যা অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। শিল্প উৎপাদন, কৃষি ও ব্যবসায় খরচ বেড়ে যায়, যার ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গ্যাসোলিনের দাম বেড়ে গেলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় এবং অনেকের জন্য দৈনন্দিন যাতায়াত ব্যয়ভার হয়ে দাঁড়ায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি মুদ্রাস্ফীতির হার ২-৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলতে পারে।

এছাড়াও, গ্যাসোলিনের উচ্চ মূল্য মানুষের পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানির প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে পারে। ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে পারে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রি ১৪ মিলিয়ন ইউনিট ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। অনেক দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রচলন বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা যায়। কিছু দেশে সরকারী নীতিমালার মাধ্যমে বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম ওঠানামার ফলে বিভিন্ন দেশে গ্যাসোলিনের মূল্য সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধ, ভূরাজনৈতিক সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উৎপাদন কমে যাওয়া বা সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটলে গ্যাসোলিনের দাম বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যা বহু দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। ২০২৩ সালে গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইসেসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ের কৌশলও গ্রহণ করা যেতে পারে। জনসাধারণের জন্য বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, যেমন গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। গবেষণা অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বছরে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসতে পারে।

ভবিষ্যতে গ্যাসোলিনের মূল্য কীভাবে পরিবর্তিত হবে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামী দিনে গ্যাসোলিনের গুরুত্ব কিছুটা কমতে পারে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাসোলিনের চাহিদা এবং মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকেই যাবে।