বিশ্বের কারাগারগুলোতে বন্দীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারাগারগুলোর অবস্থা এবং বন্দীদের জীবনমান নিয়ে গবেষণাভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ক্রিমিনাল পলিসি রিসার্চ (ICPR) পরিচালিত ওয়ার্ল্ড প্রিজন পপুলেশন লিস্ট (WPPL) প্রতিবেদন। ১৪তম সংস্করণে, বিশ্বব্যাপী কারাগারের জনসংখ্যার বর্তমান অবস্থা, বন্দীদের সংখ্যা এবং কারাগার ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের কারাগারগুলোতে বন্দীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি, অপরাধের ধরন পরিবর্তন, এবং কারাগার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি একে অপরের থেকে ভিন্ন হলেও, এশিয়া, আফ্রিকা, এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে কারাগারের ভিড় এবং বিচারাধীন বন্দীদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলোতে কারাগারে বন্দীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৬৩০ জন কারাগারে বন্দী, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রতি এক লাখে বন্দীর সংখ্যা ৩৩৪ জন এবং চীনে এই সংখ্যা ১১৮ জন। যদিও চীনে মোট বন্দীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তবে জনসংখ্যার তুলনায় এই হার অনেক কম। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মাদক ও সহিংস অপরাধের কারণে বন্দীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ইউরোপের দেশগুলোতে কারাগারে বন্দীর সংখ্যা তুলনামূলক কম এবং সেখানে পুনর্বাসনকেন্দ্রিক কারা ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়।
বিশ্বব্যাপী কারাগারের বন্দীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় সাত শতাংশ। যদিও এটি মোট বন্দী সংখ্যার তুলনায় কম, তবে নারীদের বন্দিত্বের হার গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে নারীদের কারাগারে থাকার হার বৃদ্ধির পেছনে পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। শিশু বন্দীদের সংখ্যাও উদ্বেগজনক। বিশ্বজুড়ে কয়েক লাখ শিশু বিচারাধীন অবস্থায় বা শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে রয়েছে। তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা প্রয়োজন হলেও অনেক দেশেই এই বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশের কারাগারের পরিস্থিতি এ প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দীর সংখ্যা প্রায় নব্বই হাজার, যা ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশে কারাগারগুলোর মোট ধারণক্ষমতা মাত্র চল্লিশ হাজার। এর ফলে অতিরিক্ত বন্দীর কারণে কারাগারের পরিবেশ অত্যন্ত সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিচারাধীন বন্দীদের সংখ্যা মোট বন্দীর সত্তর শতাংশেরও বেশি। এর মানে, এদের বেশিরভাগই এখনো অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে তারা দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
নারী বন্দীদের জন্য পৃথক সুবিধা অত্যন্ত সীমিত। ফলে তারা কারাগারে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিশু বন্দীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপ্রাপ্তবয়স্ক বন্দীরা প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে একই পরিবেশে থাকতে বাধ্য হয়, যা তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত ভিড় এবং অপর্যাপ্ত সেবার কারণে বন্দীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের কিছু দেশ তাদের কারাগার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নরওয়ে তাদের পুনর্বাসনকেন্দ্রিক কারাগার ব্যবস্থার জন্য সুপরিচিত। সেখানে বন্দীদের পুনর্বাসনের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়, যাতে তারা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সমাজে পুনরায় একীভূত হতে পারে। নেদারল্যান্ডসে অপরাধের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কয়েকটি কারাগার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশটি ছোটখাটো অপরাধের জন্য বিকল্প শাস্তি ব্যবস্থা চালু করেছে। জার্মানিতে বন্দীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, যা তাদের পুনর্বাসনে সহায়ক।
বাংলাদেশের জন্য এই উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। কারাগার ব্যবস্থার উন্নয়নে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে জরিমানা বা কমিউনিটি সার্ভিসের মতো বিকল্প শাস্তি চালু করা যেতে পারে। এটি কারাগারের ভিড় কমাতে সহায়ক হবে। বিচারাধীন বন্দীদের দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। কারাগারের পরিবেশ উন্নত করতে বন্দীদের জন্য আধুনিক আবাসন এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বন্দীদের পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারাগারে থাকা অবস্থায় তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে মুক্তি পাওয়ার পর তারা সমাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারেন। নারী বন্দীদের জন্য পৃথক কারাগার এবং শিশু বন্দীদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন।
ওয়ার্ল্ড প্রিজন পপুলেশন লিস্ট কারাগার ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে। এটি নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা, যা কারাগার ব্যবস্থাকে শাস্তিমূলক থেকে পুনর্বাসনমূলক করে তোলার গুরুত্ব তুলে ধরে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের জন্য এটি একটি শিক্ষা, যেখানে মানবিক এবং কার্যকর কারা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। কারাগার বন্দীদের শুধুমাত্র শাস্তি দেওয়ার স্থান নয়; এটি হওয়া উচিত তাদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের মাধ্যম। একটি মানবিক এবং কার্যকর কারাগার ব্যবস্থা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।