ঢাকারবিবার , ১৭ নভেম্বর ২০২৪
  • অন্যান্য

আজকের সর্বশেষ সবখবর

মনপুরা দ্বীপে ধ্বংসযজ্ঞ: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জেগে ওঠার আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ১৭, ২০২৪ ২:৪৩ অপরাহ্ণ । ৮ জন

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ঝুঁকি মোকাবিলায় যখন আলোচনা চলছে কপ২৯ সম্মেলনে, তখন একটি নতুন গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ধংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা মনপুরা দ্বীপকে।

জয় ভৌমিক, হাসিব মো. ইরফানুল্লাহ, সামিয়া আহমেদ সেলিম এবং মোহাম্মদ বদরুদুজ্জামান পরিচালিত এই গবেষণায় দ্বীপের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নয় এমন ক্ষতির বিষয়টিও উঠে এসেছে।

এসব ক্ষতি কমাতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি করতে দ্রুত, প্রমাণভিত্তিক নীতিনির্ধারণের আহ্বান জানানো হয়েছে এই গবেষণার ফলাফলগুলোতে।

বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় ও এর প্রভাব

২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পরিচালিত এ গবেষণা ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের অধীনে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক সেবার ওপর গুরুতর প্রভাব পড়েছে।

মানবীয় ব্যবস্থার বিপরীতে, বাস্তুতন্ত্রগুলোর এ ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা নেই; যা এই বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।

অর্থনৈতিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, মনপুরা দ্বীপের পরিবারগুলো বছরে ২৮ থেকে ৪১৯ মার্কিন ডলার (প্রায় ৩,০০০ থেকে ৪৬,০০০ টাকা) পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সেখানে ধান, মাছ, গবাদি পশু ও শস্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এসব ক্ষতি আরও বেড়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে। এটি ঝুঁকিপূর্ণ জীবিকা নির্বাহের ওপর আরও আঘাত হেনেছে। তবে গবেষণায় কেবল আর্থিক ক্ষতির পরিমাপই করা হয়নি; এটি দ্বীপবাসীদের অর্থনৈতিক নয় কিন্তু গভীর এমন ক্ষতিও তুলে ধরেছে।

এর মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি, সামাজিক ভাঙন এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস। এগুলো দ্বীপবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মানসিক কল্যাণের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

উপযোগী পদক্ষেপের আহ্বান

গবেষকরা বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক অভিযোজনের মূল ভিত্তি হিসেবে মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা ভবিষ্যতের ক্ষতি কমাতে এবং সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষা, দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও জীবিকার বৈচিত্র্যকরণে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।

গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো বাস্তব সময়ে ক্ষয়ক্ষতির দলিল রাখার জন্য ওয়েব-ভিত্তিক আইসিটি প্ল্যাটফর্মের উন্নয়ন। এসব সিস্টেম নীতিনির্ধারকদের জন্য কার্যকরী ডেটা প্রদান করবে, যা জলবায়ু হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি সৃষ্টি করতে সহায়তা করবে।

মনপুরা: গ্লোবাল মাইক্রোকোজম

বিশ্বজুড়ে অগণিত বিপদগ্রস্ত সম্প্রদায় যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে মরপুরা দ্বীপ। তাদের দুর্দশা জলবায়ু আলোচনায় অর্থনৈতিক নয় এমন ক্ষতিগুলোর অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে—এটি এমন একটি এলাকা যা প্রচলিত সামাজিকতায় প্রায়ই উপেক্ষিত।

লেখকরা উল্লেখ করেছেন ‘বাস্তুতন্ত্রের মূল্য বস্তুগত পণ্যকে ছাড়িয়ে যায়’। নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে, তারা যেন একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন; যা বাস্তুতান্ত্রিক সেবার সাংস্কৃতিক, আবেগীয় ও মানসিক মাত্রাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়।

ভূমি ও ঐতিহ্যের ক্ষয়

বছরের পর বছর, মনপুরা উল্লেখযোগ্য বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে:

ভূমি হ্রাস: দ্বীপটির আয়তন ১৯৭৩ সালে ১৪৮ বর্গ কিলোমিটার ছিল। ২০১০ সালের মধ্যে তা কমে মাত্র ১১৪ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।

মাটি ক্ষয়: ভারী বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ের স্রোত ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপরিভাগের উর্বর মাটি উধাও হয়ে যাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং জীবিকা নির্বাহকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

শস্যের ক্ষতি: রূপগত পরিবর্তন এবং মানুষের কার্যকলাপের কারণে ১৯৯০ সাল থেকে কৃষি জমির পরিমাণ ৩৮ শতাংশ কমে গেছে।

সাংস্কৃতিক ক্ষয়: দ্বীপটির অমূল্য ক্ষতিগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যহীনতা, মানসিক চাপ ও অস্তিত্বের সংকট, যা তার বাসিন্দাদের তাদের ঐতিহ্য থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে।

কপ২৯-এ বাংলাদেশের ভূমিকা

বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। মনপুরা দ্বীপের দুর্দশা বাস্তব সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে। ভৌমিক এবং তার সহকর্মীদের গবেষণায় জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে স্থানীয় বাস্তবতার ভিত্তিতে সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

গবেষণার ফলাফলে বাস্তুতান্ত্রিক সেবার ভৌত ও অদৃশ্য উভয় দিকগুলোর সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকট প্রকট তাই সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য সামনের সারিতে থাকা সম্প্রদায়ের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

গবেষকদের মতে, মনপুরার গল্পটি কেবল একটি সতর্কবার্তা নয়, এটি বাংলাদেশ ও এর বাইরেও টেকসই, ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান।