বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের ইতিহাসে টাকার অংকে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যত ‘নন-আরবান হেভি রেল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার মধ্যে এ প্রকল্পের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি। একইভাবে প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঢাকার ‘এমআরটি লাইন-৬’। ঢাকার দ্বিতীয় (এমআরটি লাইন-১) ও তৃতীয় (এমআরটি লাইন-৫, নর্দান রুট) মেট্রোরেলের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় আরো বেশি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ২০০ কোটি টাকার বেশি, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে চার-ছয় লেনের মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, রেলপথ, রেল সেতু, বিমানবন্দরের টার্মিনালের মতো যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই নির্মাণ ব্যয় গোটা পৃথিবীতে সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বা অন্যতম সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার পর্যালোচনার হিসাবেও বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে।
দেশের সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্পগুলোর একটি পদ্মা সেতু। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। সেতুটি নির্মাণে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি অর্থ খরচ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমজাতীয় সেতুর কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় যদি আমরা হিসাব করি, তাহলে দেখা যাবে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুই থেকে তিন গুণ বেশি খরচ হয়েছে। কেন বেশি খরচ হয়েছে তা খুঁজলে দেখা যাবে, এ প্রকল্পের সঙ্গে সামরিক-বেসামরিক স্থাপনাও তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও এমন নজির পাওয়া যাবে না। এখানে থানা হয়েছে। প্রকল্পের কর্মকর্তা, সচিবদের থাকার জন্য বাংলো বানানো হয়েছে। এমন নানা অকার্যকর অনুষঙ্গের জন্য বিপুল পরিমাণ জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যা প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
শুধু পদ্মা সেতু নয়, প্রত্যেক প্রকল্পেই এমন ‘শ্যাডো কস্ট’ নির্মাণ ব্যয় বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রকল্প মানেই দামি গাড়ি কেনা। যে কাজের জন্য দরকার পিকআপের মতো যানবাহন, সে কাজের জন্য কেনা হয় পাজেরো। ফ্রিতে পাওয়া জ্বালানি তেল পুড়িয়ে সে গাড়ি ব্যবহার করা হয় ব্যক্তিগত কাজে। ট্রান্সফার অব টেকনোলজির নামে করা হয় বিদেশ ভ্রমণ। যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাদেরও খুশি রাখতে হয়। এটা সরকার ও প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত করা হয়। কারো কারো সুযোগ-সুবিধা যখন প্রত্যেকটা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তখনই দেখা যায় ব্যয় বেড়ে গেছে। জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাবে এসব ঘটনা দেশে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।’
ভারতে আট লেনের জাতীয় বা প্রাদেশিক মানের এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ১৫ লাখ ডলার। জেলা ও শহরাঞ্চলের জন্য দুই লেনের প্রতি কিলোমিটার সড়ক তৈরিতে ব্যয় হয় প্রায় ৬ লাখ ডলার। প্রান্তিক সড়কের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় পড়ে প্রায় ৪ লাখ ডলার। সঠিক পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, দক্ষ জনশক্তি, নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানাবিধ কারণে এশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে কম খরচে সড়ক তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে ভারত।
ঠিক উল্টো অবস্থা বাংলাদেশের। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এখানে প্রতি কিলোমিটার চার বা ততোধিক লেনের সড়ক নির্মাণ করতে ২৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার জন্য উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক।
শুধু সড়ক, মেট্রোরেলের নির্মাণে অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। ঢাকার প্রথম মেট্রো নির্মাণে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে প্রথম মেট্রো তৈরি হয় ভারতের দিল্লিতে। ঢাকা এমআরটি-৬-এর অর্ধেকেরও কম খরচে লাহোরে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে পাকিস্তান। অন্যদিকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে প্রথম মেট্রো তৈরি করেছে চীন। দেশটির সাংহাই শহরের প্রথম মেট্রোটির নির্মাণ ব্যয় ঢাকার এমআরটি-৬-এর নির্মাণ ব্যয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ঢাকার চেয়ে কম খরচে দুটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে ভিয়েতনামের দুটি শহরে। ঢাকায় নির্মাণাধীন দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আরো বেশি।
যমুনা নদীতে বিদ্যমান সেতুর সমান্তরালে নির্মিত হচ্ছে একটি রেল সেতু। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেল সেতু নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৩ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ের দিক থেকে এ অংক প্রতিবেশী ভারত ও চীনের দীর্ঘ ও বৃহদায়তনের রেল সেতুগুলোর চেয়েও অনেক বেশি। অন্যদিকে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হিসেবে অভিহিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
আশপাশের দেশগুলো কম খরচে অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারছে না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বুয়েটের আরেক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, মহাসড়ক, রেলপথ নির্মাণের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং এখনো যেগুলোর কাজ চলমান, সেগুলোর কারিগরি মান আশপাশের দেশে বাস্তবায়িত সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর মতোই। কিন্তু আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। আমরা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে যে অর্থ ব্যয় করেছি, তার তিন ভাগের এক ভাগ ব্যয় আশপাশের দেশগুলো একই প্রকল্প করেছে। আশপাশের দেশগুলো যদি কম খরচে মেট্রোরেল, সড়ক, সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে পারে, আমরা কেন পারব না, এটা বড় প্রশ্ন। আমি মনে করি, যেখানে বিনিয়োগটা ভারী হয়, সেখানে যারা ব্যক্তিগতভাবে প্রকল্প থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে, তাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’
বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় ফুলিয়ে-ফাপিয়ে বড় করে দেখানোর এক ধরনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পগুলোর ব্যয় এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যেন সেগুলো মেগা আকৃতি ধারণ করে। অথচ এ ব্যয়টা হওয়ার কথা ছিল গবেষণাভিত্তিক। কীভাবে কম খরচে ভালো অবকাঠামো তৈরি করা যায় সেই চেষ্টা আমাদের দেশে নেই। আমি মনে করি, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়েছে কিনা, কারিগরি অনিয়ম হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত।’
যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। প্রকল্পে ব্যয় হওয়া ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার সিংহভাগই এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের পরিমাণ ২৬৭ কোটি ডলার। চুক্তিতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ধরা হয় ৭৮ টাকা ৮৫ পয়সা। প্রতি ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ১১৮ টাকা। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ঋণের পরিমাণ ও ঋণ পরিশোধের চাপ—দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে।
উচ্চ ব্যয়ের এ প্রকল্প থেকে যে রিটার্ন সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে, তা ঋণের কিস্তির তুলনায় নগণ্য বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রকল্প বাস্তবায়নে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করেছি। যে ব্যয় করা উচিত তার চেয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ বেশি ব্যয় করে আমাদের ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের রিটার্নের সঙ্গে বিনিয়োগ অসামঞ্জস্য হয়ে গেছে। এর খেসারত কিন্তু দেশের জনগণকে দিতে হবে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কথাই যদি আমরা ধরি, এ প্রকল্পে দিনে দুই-তিনটা ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে এখন। ট্রেনগুলো পরিচালনা করে যে রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে, প্রকল্পের ঋণের কিস্তির পরিমাণ কিন্তু তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হচ্ছে।’
বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হওয়ার পেছনে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যুক্তি দিয়ে আসছিলেন, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার কথা। তারা বলেছেন, নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে সেতু-কালভার্ট বেশি করতে হয়েছে। উঁচু সড়কবাঁধ তৈরি করতে হয়েছে। নরম মাটির কারণে পিলার গভীরে নিতে হয়েছে। আর ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রীর বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়েছে। এসব বিষয় অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে বলে বিভিন্ন সময় মন্তব্য করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। সরকারি কর্মকর্তারাও একই সুরে কথা বলেছেন।
যদিও এ যুক্তি পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এসব ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের কারণে প্রকল্প ব্যয় কিছুটা বেশি হতে পারে। এসব ব্যয় আমলে নিলেও দেখা যাবে এখানে নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন তুলনামূলক স্টাডি করা হয়েছে, সেখানেও কিন্তু এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার বিষয়গুলো অবশ্যই পর্যালোচনা করা দরকার, যেন সামনের দিনে আমরা যখন এ ধরনের স্থাপনা করব, সেগুলো যাতে আমরা ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে করতে পারি।’