ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৩ মে ২০২৪
  • অন্যান্য

`মোড়কে বড় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী : তামাক ত্যাগে উদ্ধুদ্ধ করে’

নিজস্ব প্রতিবেদক
মে ২৩, ২০২৪ ৫:৫৪ অপরাহ্ণ । ১৯৩ জন

তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতির মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান অন্যতম। তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে বড় ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করা সম্ভব হলে, আরো বেশি জনগোষ্ঠীকে তামাক সেবনে উদ্ধুদ্ধ করা সম্ভব হবে। বিশ্বের র ১৩৮টি দেশে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করা হয় যার মধ্যে ৭৬টি দেশেই এই ছবির আকার মোড়কের ৬৫ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধনী ২০১৩) এর ধারা ১০ অনুযায়ী সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের উভয়পাশের মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ এলাকা জুড়ে তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পকিৃত সচিত্র সতর্কবার্তা প্রদান করতে হবে। তবে ২০১৬ সাল বাংলাদেশে হতে ৫০ শতাংশ সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হলেও গত ৮ বছরে এই কোন পরিবর্তন হয়নি, তবে একই সময়ে ছবি প্রদানকারী দেশ মায়ানমার ৮বার, ফিলিপাইন ৫ বার, কম্বডিয়া ও সাউথ কোরিয়া ৪ বার করে এই ছবি পরিবর্তন ও পরিধি বৃদ্ধি করেছে। বিশে^র অন্যান্য দেশেও ইতোমধ্যেই এই ছবির পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং তারা প্লেইন প্যাকেজিং ও স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন করেছে। বিশে^ও ৪২টি দেশ/অঞ্চল প্লেইন প্যাকেজিং গ্রহণ করেছে। তামাকজাত দ্রব্যের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং এর ফলে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব। তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের ৯০ শতাংশ স্থান জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সেট পরিবর্তন করা একান্ত জরুরী।

আজ ২৩ মে ২০২৪ (বৃহস্পতিবার) সকাল ১১.০০ টায় কনফারেন্স হল, সংসদ ভবনের পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবে,টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভির্সিটি ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (বাটা)-এর আয়োজনে ‘সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী: বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় ডেপুটি স্পিকার জনাব শামসুল হক টুকু, এমপি। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ মোঃ আব্দুল আজিজ এমপি; ডাঃ মোঃ তৌহিদুজ্জামান এমপি; অধ্যাপক ডাঃ প্রান গোপাল দত্ত এমপি, আহমেদ ফিরোজ কবির এমপি; জনাব আরমা দত্ত এমপি; জনাব উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপি, ড. শ্রী বীরেন শিকদার এমপি; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক সমন্বয়কারী (অব: অতিরিক্ত সচিব) মোঃ হোসেন আলী খোন্দকার, ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের হেড অব প্রোগ্রামস মোঃ শফিকুল ইসলাম, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (ঘাই) বাংলাদেশের কনসালটেন্ট মোঃ শরিফুল আলম, ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের সিনিয়র কারিগরি পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন ও কারিগরি পরামর্শক জনাব আমিনুল ইসলাম সুজন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক; এইড ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টর শাগুফতা সুলতানা; স্টপ-এর ফোকাল পারসন ফাহমিদা ইসলাম প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন সাবেক সংসদ সদস্য এবং টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)- ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)-এর সদস্য সচিব ও প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মোঃ বজলুর রহমান। এছাড়াও অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, এবং বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব শামসুল হক টুকু, এমপি বলেন, সিগারেট হচ্ছে মাদকের প্রবেশদার। মাদকমুক্ত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল। আর দেশকে মাদকমুক্ত করতে হলে সবার আগে তামাকমুক্ত করতে হবে। একারণেই সংবিধানে মদ-জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য সিগারেট ও মাদককে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন আরো শক্তিশালী করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে নিয়ে এটিকে প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্য ৩ (ক)- তেও তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রদান করা হয়েছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা কওে অনতিবিলম্বে আমাদের দেশেও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানীর আকার ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। এবং তামাক নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী করতে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে এবং ৫টি মন্ত্রণালয়কে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এরমধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, স্থানীয় সরকার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ। একজনের ধূমপানের কারণে আশেপাশের অনেকেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। তাই ধূমপায়ীকে যেন অধূমপায়ীরা প্রশ্ন করতে পারে সেই বিষয়ে প্রয়োজনে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডাঃ মোঃ তৌহিদুজ্জামান এমপি বলেন, মানুষকে সচেতন করতে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার বৃদ্ধির করে ৯০ শতাংশ করা একান্ত প্রয়োজন। পাশাপাশি কর বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধির করতে হবে যাতে এইজাতীয় পণ্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।

ড. শ্রী বীরেন শিকদার এমপি বলেন, খোলা তামাক ও খুচরা বিক্রয় বন্ধ না করলে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এছাড়া ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা এখনই করতে হবে।

ডাঃ আব্দুল আজিজ এমপি বলেন, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়নের জন্য স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন জরুরি। পাশাপাশি উৎস থেকে নির্মূল করতে হবে। চাষ বন্ধ করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

জনাব আরমা দত্ত এমপি বলেন, বড় আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী জনসচেতনতা বৃদ্ধির করতে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির করতে হবে। এজন্য প্রতিটি স্কুল-কলেজে এন্টি টোব্যাকো ক্লাব তৈরি করতে হবে।

জনাব উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপি বলেন, সমাজকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবেই অনেকগুলো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় আর সেক্ষেত্রে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এ বিষয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। তাই আইন সংশোধন করে এটির পরিধি বৃদ্ধির করতে হবে। ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ও তরুণ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের সংসদ সদস্যদের এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এতো বছর ধরে কাজ করে একটা জিনিস দেখেছি যে তামাক নিয়ন্ত্রণে আইনে কোন পরিবর্তন আনতে গেলে সেটার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কারন তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে বার বার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ব্যহত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানীর অবস্থা অনেকটাই নাজুক। আমাদের দেশের তামাকজাত দ্রব্যের ছবির সাইজ, ছবির অস্পষ্টতা এবং মাড়কের ভিন্নতা এর প্রধান কারণ। পাশাপাশি তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে আইন বাস্তবায়নে অন্ততম অন্তরায়।

আইনে উপরের দিকে ছবি প্রদানের কথা থাকলেও তামাক কোম্পানি মোড়কের নিচের দিকে মুদ্রিত হয়ে আসছে, এমনকি হাই কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করেই। এভাবে ৮ টি বছর কেটে গেছে। কিন্তু এর থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। অন্যান্য দেশের দিকে তাকান, পৃথিবীর ৭৬টি দেশ ৬৫ শতাংশ কিংবা তার অধিক আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদান করে থাকে। এদের মধ্যে এমন অনেক দেশ আছে যারা বাংলাদেশের পরে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদান শুরু করেছে কিন্তু তারাও বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এই এত বছরের মধ্যে আমরা একবারো সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানীর ছবির সেট পরিবর্তন করতে পারিনি। তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার। আর স্টান্ডার্ড প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানীর সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব। তামাকজাত পণ্যের মোড়কের ভিন্নতা, মানহীন মোড়ক, সাইজের ভিন্নতা, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের উপযুক্ত মোড়ক না থাকা, এসকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়নে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।