ঢাকামঙ্গলবার , ২ এপ্রিল ২০২৪

যানজটের কারণে পুরোনো ঢাকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
এপ্রিল ২, ২০২৪ ৪:২২ অপরাহ্ণ । ৮৪ জন

যানজটের কারণে পুরোনো ঢাকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবহার, পার্কিং সুবিধানিশ্চিতকরণ, ফুটপাত অবৈধ দখলদার মুক্ত করা, ওয়ান-ওয়ের পাশাপাশি আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা চালুকরা, সুনিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যপরিবহন নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি গৃহীত উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

আজ (২ এপ্রিল ২০২৪) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) উদ্যোগে আয়োজিত ‘পুরনো ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে যানজটের প্রভাব ও উত্তরণের উপায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।

সেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মোঃ মুনিবুর রহমান এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মিসেস নীলিমা আখতার-এ মতবিনিময় সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, দেশের জিডিপিতে পুরোনো ঢাকার অবদান প্রায় ২০% হলে, অপর্যাপ্ত অবকাঠমো, যানজট ও অপ্রতুল পরিসেবার জন্য এ এলাকার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, রাজধানীর ঢাকার যানজটের কারণে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রায় ২.৯% হ্রাস পায় এবং প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যামের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া কর্মঘন্টার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সড়কের খোড়াখুড়ি, অবৈধ ফুটপাত দখল, অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিং, অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো ও অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে বিশেষকরে পুরোনো ঢাকায় সৃষ্ট সহনীয় যানজট পরিস্থিতি ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ হতে উত্তরণে স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম চালুকরণ, নদীপথের ব্যবহার বাড়ানো এবং পুরোনো ঢাকার প্রধান সরু ও ব্যস্ত সড়কে একমুখী ট্রাফিক ব্যবস্থা চালুকরণের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকার অপরিকল্পিত নগারয়নের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী, আমরাই এটা সৃষ্টি করেছি। নগরের অভিবাবক হিসেবে সিটি কর্পোরেশন নগরের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে এবং সেমতে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে তিনি অভহিত করেন।

তিনি জানান কোন ধরনের কর বৃদ্ধি ছাড়াই সুশাসন নিশ্চিতকরার মাধ্যমে ২০২৩ সালে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ১০৩১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল, ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫১২ কোটি টাকা। তিনি বলেন, নগরের জলব্ধতার বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং সম্প্রতি বেশকিছু খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতে এ সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। মেয়র জানান, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত কেরানীগঞ্জে নতুন বাণিজ্যিক নগরী গড়ে তোলা হবে, সেই সাথে চকবাজার ও মতিঝিল কে পুনরুজ্জীবিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, সায়াদাবাদ বাস টার্মিনালকে আধুনিক সুবিধায় রপ্তান্তরিত করা হয়েছে এবং এটার উদ্বোধনের পর আর কেউ টার্মিনালের বাইরে বাস কাউন্টার স্থাপন করতে পারবে না। দোকানের সামনের হকারদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে যানজট নিরসন ও ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের সনাক্তকরণে ৬৪টি ইন্টারসেকশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আইওটি) প্রযুক্তি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তা হতে হকারদের উচ্ছেদের বিষয়ট এত সহজ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৮টি স্থানকে হলুদ ও সবুজ জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে হকাররা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারবে, তবে সিটি কর্পোরেশনের চিহ্নিত লাল জোনে কেউ দোকান বসাতে পারবে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মোঃ মুনিবুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে ব্যবহার যোগ্য রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ, ফলে আমাদের রাস্তার উপর গণমানুষ ও পরিবহনের চাপ অত্যাধিক। তিনি বলেন, চকবাজার, মৌলভীবাজার, ছোট কাটরা ও বড়কাটরা, পাটুয়াটুলি সহ অন্যান্য এলাকায় যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া উক্ত এলাকায় পাইকারীবাজার সমূহে পার্কিং সুবিধা না থাকার যানজট লেগে থাকে এবং গুলিস্তানে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া গেলে যানজট আরো কমবে তিনি মত প্রকাশ করেন, সেই সাথে হকারদের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে যানজট হ্রাস পাবে। তিনি পুরোনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্কাইওয়াক স্থাপন ও স্মার্ট পার্কিং চালুকরনের প্রস্তাব করেন। তিনি জানান, ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সাথে ১৮টি স্টেকহোল্ডার রয়েছে, সকলের মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো গেলে যানজট আরো কমনো সম্ভব হবে।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, পুরোনো ঢাকার যানজটের নিরসনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অংশগ্রহণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়াও উক্ত এলাকায় গাড়ি পার্কিং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন ও পণ্যপরিবহন ব্যবস্থার বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

নির্ধারিত আলোচনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সিইও মোঃ মিজানুর রহমান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন, ঢাক ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানী লিমিটেডর পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোঃ আব্দুল বাকী মিয়া প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, যানজট নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, এছাড়াও ঢাকা হতে আন্তঃজেলা বাস টার্নিমালগুলো সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং পোাস্তগলা থেকে গাবতলী পর্যন্ত একটি ইনার সার্কুলার রোড নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যা আরো নিরসন হবে। তিনি বলেন, ভ‚মি দস্যুদের হাত থেকে নদী ও খাল উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর ফলে পানি নিষ্কাশন এবং জলাবদ্ধতা দূরীভূত হবে। ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, যানজট নিরসনে পুরোনো ঢাকায় কিছু কিছু রাস্তায় ওয়ান-ওয়ে কার্যক্রম চালুকরণ এবং বুড়িগঙ্গার নাব্যতা বাড়িয়ে নদীপথের ব্যবহার বাড়ানোর উপর জোরারোপ করেন। মোঃ আব্দুল বাকী মিয়া বলেন, মেটোরেল-৬ বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় আড়াই থেকে তিন লক্ষ যাত্রী পরিবহন করছে, যা যানজট নিরসনের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অনুষ্ঠানের মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আলহাজ আব্দুস সালাম, বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল হাসেম, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি আলীমুজ্জামান আলম, বাংলাদেশ গার্মেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন আলমগীর, বাংলাদেশ পাইকারী ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মওলা, এফবিসিসিআই’র পরিচালক হাফেজ হারুন, ডিসিসিআই’র প্রাক্তন পরিচালক আলহাজ মোহাম্মদ শরফুদ্দিন এবং বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন অংশগ্রহণ করেন।

আলোচকবৃন্দ চকবাজারের যানজট নিরসনে কমিউনিটি পুলিশের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, পুরোনো জেলখানায় গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা চালুকরণ, পুরোনো ঢাকা হতে অন্যান্য স্থানে যাওয়ার জন্য মেট্রোরেল সেবা চালু, ব্যস্ততম সড়কসমূহে ওয়ান-ওয়ে ব্যবস্থা চালু, দিনের বেলায় পুরোনো ঢাকায় কাভার্ড ভ্যানগুলোর চলাচল বন্ধ, বিশেষকরে লক্ষীবাজার ও নবাবপুর সহ অন্যান্য এলাকার ফুটপাত হতে দোকান উচ্ছেদ এবং ধোলাইখালের ট্রাক স্ট্যান্ড অন্যত্র স্থানান্তরের উপর জোরারোপ করেন।

ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সহ পুরোনো ঢাকার বিশেষায়িত সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।