ঢাকাবুধবার , ১৮ অক্টোবর ২০২৩
  • অন্যান্য

রিফিউজি : দেশ ছেড়ে নিঃস্ব মানুষ, বাড়ছে সংকট

সানজিদা সুমাইয়া
অক্টোবর ১৮, ২০২৩ ১:৪৭ অপরাহ্ণ । ৮৮২ জন

রিফিউজি শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেঁড়া কাপড় পরিহিত কালিমাখা মলিন চেহারার মানুষের ছবি। টিভি পর্দায় বা পত্রিকায় এদের ছবি দেখে আমরা আহা- উঁহু করি ঠিকই কিন্তু পাতা উল্টালেই আবার ভুলে যাই। বর্তমান বিশ্বের মানবিক সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম এই রিফিউজি বা শরণার্থী সমস্যা।

রিফিউজি বা শরণার্থী বলা হয় সেসব মানুষকে যারা জীবন বাঁচাতে বা শাসক কিংবা সংখ্যাগুরুদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে নিজেদের বাড়ি-ঘর বা দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও মতামত প্রকাশ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। যুদ্ধ বা মানুষ সৃষ্ট অন্যান্য প্রতিকুল পরিবেশের কারণে যখন মৌলিক অধিকার ব্যাহত হয়, মূলত তখনই মানুষ দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ,অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হতে হয় শান্তিপ্রিয় জনসাধারণকে। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের ভার বহন করে এক বুক হতাশা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে সাধারণ গৃহস্থকে হতে হয় গৃহহীন, করুণার পাত্র।

সাম্প্রতি রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর আমরা এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি। শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থ হাসিলের জন্য হাজার হাজার মানুষকে নিঃস্ব হতে হয়েছে। জীবন বাঁচাতে আরও অনেকে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গিয়েছেন।

সকলেই আশা করে দ্রুত অবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেকাংশেই ভিন্ন। কোন কোন দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিকূল অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে, ফলে সেসব দেশের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত অচেনা দেশে যাযাবরের জীবন পালন করে।

বর্তমানে তুর্কি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে আগত প্রায় ৩ মিলিয়ন অসহায় মানুষের ঠিকানা এখন তুর্কি। শরণার্থী সূচকে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রিফিউজিদের প্রায় সবাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ। আদিকাল থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বাস করছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার বরাবরই তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। এমনকি ২০১৪ সালে আদমসুমারিতেও তাদের গণনা করেনি মিয়ানমার সরকার।

বিভিন্ন রকম অত্যাচার ও বৈষম্যের ফলে ১৯৮০ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন গ্রহণ করছে। তবে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে সামরিক চাপে রোহিঙ্গারা দলে দলে কক্সবাজার, টেকনাফ ও অন্যান্য সীমান্তবর্তী স্থানে পালিয়ে আসে। হঠাৎ এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। এত মানুষের অন্ন, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা জোগানো মটেও সহজ ছিল না। তবে মানবিক দিক থেকেই রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে স্থানীয়রা। বিভিন্ন সময়ে কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ায় একাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপন করেছে বাংলাদেশ সরকার। স্বল্পউন্নত দেশ হয়েও রিফিউজিদের জন্য বাংলাদেশের পদক্ষেপ বিশ্ব মঞ্চে বারবার প্রশংসিত হয়েছে।

মেঘনার মুখে প্রাকৃতিকভাবে পলি জমে তৈরি হয়েছে ভাসান চর। সেখানে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য গড়ে তুলেছে আরেকটি রিফিউজি ক্যাম্প। কনক্রিটের বাসস্থান, বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, খাদ্য সঞ্চয় ও অন্যান্য কাজের জন্য ব্যাবহ্রিত গুদাম-ঘর এবং সোলার পাওয়ার গ্রিড নির্মিত হয়েছে ভাসান চরে।

ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করলেও রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থী বেকার থাকলে তা আশ্রয়দাতা দেশের জন্যও সমস্যা উদ্রেক করে। নানা রকম বেআইনি কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধান করতে আবারও এগিয়ে এসেছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

দৈনিক মজুর বা কারিগরি কাজে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। বহু রোহিঙ্গা ইতোমধ্যেই এ ধরনের কাজে যুক্ত হয়েছেন বা কৃষিকাজ করে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছেন। শুধু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানই নয়, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের জন্য সচেষ্ট রয়েছে সরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। ইউনিসেফ, ইউএনএইচসিআর বিভিন্নভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে।

কিন্তু ভৌগোলিক সীমানা মেনে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সকল অধিকার রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। তাই রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান হল তাদের পুনর্বাসন। এই লক্ষে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার মিয়ানমারের সাথে বৈঠক করেছে। বিভিন্ন সমায়ে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিভিন্ন  পরিকল্পনা করা হলেও তার কোনটাই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বন্ধ হয়নি রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের নিপীড়ন। রাজনৈতিক ও সামরিক কারণে সীমাহীন কষ্ট ও অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

লেখক : শিক্ষার্থী,  বুয়েট