ঋতু বদলের নিয়মে শীত চলেই এল। এ সময় শিশুদের প্রায়ই ঠান্ডা লেগে নাক দিয়ে পানি পড়ে। তা থেকে হয় কাশি, শ্বাসকষ্ট। অবস্থা গুরুতর হয়ে অনেক সময় হাসপাতালে চিকিৎসারও প্রয়োজন পড়ে।
শীতকালে নাক, কান, গলা থেকে শ্বাসনালি হয়ে ফুসফুস পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্রের যে কোনো জায়গায় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো জীবাণুর সংক্রমণের আশংকা বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ গলা বা নাকেই সীমাবদ্ধ থাকে। ভাইরাসের কারণে হয় বলে জটিল হয় না। তবে সংক্রমণ যখন বুকের ভেতর ফুসফুসে ছড়িয়ে যায়, তখন তা মারাত্মক হয়ে যায়।
শীতের সময় শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাড়তি নজর দিতে হবে। ফুসফুসের যে সব সংক্রমণ ও প্রদাহে শিশুদের কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হয়ে থাকে, তার মধ্যে নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কিওলাইটিস অন্যতম। রোগ দুটোর উপসর্গ ও লক্ষণে অনেক মিল আছে। তবে সংক্রমণের কারণ, ধরন ও জটিলতায় আছে অনেক অমিল। অমিল আছে চিকিৎসার পদ্ধতিতেও।
মানুষের বুকের দুপাশে দুটো ফুসফুস। দেখতে ঠিক ওল্টানো গাছের মতো। গাছের যেমন ডালপালা ও পাতা থাকে, ফুসফুসেও তেমনি গাছের ডালপালার মতো শ্বাসনালি আছে, যার ভেতর দিয়ে শ্বাসের সঙ্গে আসা অক্সিজেন ফুসফুসের অ্যালভিওলাসে (বাতাসের থলি) পৌছে যায়। এখানেই ঘটে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিনিময়। অ্যালভিওলাসে থাকা অক্সিজেন যায় রক্তে আর রক্ত থেকে বেরোনো বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আসে অ্যালভিওলাসে, যা শ্বাসনালি দিয়ে অবশেষে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
এই ওল্টানো গাছের পাতার বোঁটাসদৃশ শ্বাসনালির শেষ অংশে প্রদাহ হলে তাকে বলা হয় ব্রঙ্কিওলাইটিস আর পাতাসদৃশ অ্যালভিওলাসে প্রদাহ হলে তাকে বলা হয় নিউমোনিয়া। ব্রঙ্কিওলাইটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় আরএসভি (রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল) নামের এক রকম ভাইরাস দিয়ে; নিউমোনিয়া হয় মূলত ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে।
ব্রঙ্কিওলাইটিস
এটি সাধারণত দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের হয়ে থাকে। তবে এক বছরের কম বয়সীরা আক্রান্ত হয় বেশি। নাক দিয়ে পানি পড়ার মাধ্যমে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত শিশুরা হাসি-খুশি থাকে, জ্বরও তেমন থাকে না, তবে প্রচণ্ড কাশিই এ রোগের প্রধান লক্ষণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো আওয়াজ পাওয়া যায়। অর্থাৎ দুই বছরের কমবয়সী শিশু যদি হাসি-খুশি থাকা সত্ত্বেও অনেক কাশি ও শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো আওয়াজ করে, তাহলে ব্রঙ্কিওলাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
শ্বাসতন্ত্রের এ রোগের ক্ষেত্রে বুকের এক্স-রে করলে ফুসফুসে তেমন কিছু পাওয়া যায় না, তবে ফুসফুস একটু বেশি কালো দেখা যায় এবং অনেকসময় একটু বড়ও লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন কোনো চিকিৎসাও লাগে না।
যা করবেন
শিশুর মাথার দিকটা একটু উঁচু রেখে শোয়াতে হবে। মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার দেবেন। নাক দুটো পরিষ্কার করে দিতে হবে বার বার। তেমন কোনো ওষুধ প্রয়োজন হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই বছর বয়সের পর এ রোগের প্রকোপ কমে একসময় ভালো হয়ে যায়।
তবে কখনো কখনো এ রোগ মারাত্মকও হতে পারে। তখন প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়, শ্বাসের গতি অনেক বেড়ে যায়, বুকের খাঁচা দেবে যায়, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, শিশু দুধ পান করতে পারে না এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করে অক্সিজেন ও স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
এ রোগের চিকিৎসায় তেমন কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কালেভদ্রে আক্রান্ত কোনো কোনো শিশুর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে পিআইসিইউ (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) দরকার হয়।
ব্রঙ্কিওলাইটিসের আরেকটা বিশেষত্ব হলো, কিছুদিন পর পর আক্রান্ত হওয়া। মায়ের বুকের দুধ পান নিশ্চিত করতে পারলে রোগের তীব্রতা অনেক কমানো সম্ভব।
নিউমোনিয়া
নিউমোনিয়া যে কোনো বয়সে হতে পারে। তবে ৫ বছরের কমবয়সী শিশুদের এ রোগ বেশি হয় এবং এর মৃত্যুহারও বেশি। অপুষ্টি, পরিবেশ ও বায়ুদূষণ, বিশেষ করে ঘরের ভেতর রান্না বা ধূমপানের ধোঁয়া নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর অনেক জ্বর হয় আর অতি দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। খাওয়া- দাওয়া ছেড়ে দেয়, ঝিমিয়ে পড়ে। নাকে পানি থাকে না। কাশি হলেও বাঁশির মতো আওয়াজ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর মধ্যে পাওয়া যায় না। অনেকক্ষেত্রে আক্রান্ত শিশুর বেশ শ্বাসকষ্ট হয়, রক্তের অক্সিজেন দ্রুত কমে যায়।
নিউমোনিয়া হলে বুকের এক্স-রেতে ফুসফুসে অনেক ক্ষতচিহ্ন দেখা যায় এবং এ রোগে মৃত্যু-ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক ও অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা শুরু না করলে শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
বুকের দুধ দেওয়ার পাশাপাশি নিউমোনিয়ার জন্য নির্ধারিত টিকা দিলে এবং পরিচর্যাকারীর নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাসসহ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
অভিভাবকদের করণীয়
১.শিশুর কাশি ও জ্বর হলে তার সব ধরনের পরিচর্যা আগের মতো অব্যাহত রাখতে হবে।
২. বার বার নাক পরিষ্কার করে দিলে ভালো। শোয়ানোর সময় মাথার দিকটা বালিশে একটু উঁচু করে দিন।
৩. জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল দেওয়ার পাশাপাশি কুসুম গরম পানিতে কাপড় বা তোয়ালে ভিজিয়ে মাথাসহ পুরো শরীর ভালোভাবে মুছে দিতে হবে।
৪. মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার দিতে হবে, তবে খাওয়ানোর সময় জোরাজুরি করা যাবে না।
৫. কাশির জন্য একটু লেবুর চা, লেবুর রস ইত্যাদি দিতে হবে, কোনো কাশির ওষুধ বা কফের সিরাপ নয়।
৬. খেয়াল রাখতে হবে, শিশু আগের চেয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে কি না। শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের নিচের অংশ দেবে যাচ্ছে কি না। এ দুটোর কোনো একটা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ বা হাসপাতালে নিতে হবে।
নোট: শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ডা: মো: আবিদ হোসেন মোল্লার লিখিত ‘শিশু স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে তাঁর অনুমতিক্রমে।