জীবনধারণের অভ্যাস এবং স্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। প্রতিদিন আমরা যে কাজগুলো করি, যেমন খাওয়া, ঘুমানো, ব্যায়াম, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া, সেগুলো আমাদের দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো দেখিয়েছে যে, সঠিক অভ্যাস রক্ষা করলে দীর্ঘজীবন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন সম্ভব।
খাদ্য আমাদের জীবনের অন্যতম মৌলিক চাহিদা, কিন্তু কী ধরনের খাবার আমরা খাই তা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, সুষম খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি পরিমাণে সবজি, ফলমূল, এবং প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। অধ্যাপক মার্গারেট রেমন্ড, যিনি নিউট্রিশন সায়েন্স নিয়ে কাজ করেন, বলেন, “স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মানে এমন খাবার খাওয়া যা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।”
পর্যাপ্ত প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট শরীরের সঠিক কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করে। তেলযুক্ত খাবার, চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা বলছে, দিনের শুরুতে ভারী প্রাতঃরাশ এবং হালকা রাতের খাবার খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বিপাকীয় কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারার অন্যতম প্রধান অংশ হলো নিয়মিত ব্যায়াম। ব্যায়াম কেবলমাত্র শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণেই সাহায্য করে না, এটি মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতেও সহায়ক। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের (AHA) মতে, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করা উচিত। এটি রক্তচাপ কমাতে, হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে।
অধ্যাপক ড্যানিয়েল মার্কস, যিনি শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বলেন, “নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের বিপাকীয় গতি বাড়ায় এবং মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।” যোগব্যায়াম এবং ধ্যান বিশেষত মানসিক চাপ কমাতে এবং মনের স্থিরতা বজায় রাখতে অত্যন্ত কার্যকর।
শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বও সমান। মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং ডিপ্রেশনের মতো সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক অসুস্থতার কারণ হতে পারে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত আবেগজনিত সমস্যা হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সামাজিক সংযোগ, পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং নিজেকে মানসিকভাবে ব্যস্ত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক এলিজাবেথ স্মিথের মতে, “ধ্যান এবং সচেতনতা অনুশীলন করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের স্থায়ী উন্নতি সম্ভব।” নিয়মিত ধ্যান, পর্যাপ্ত ঘুম, এবং শখ চর্চা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক।
ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের পুনরুজ্জীবনের জন্য অপরিহার্য। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC)-এর মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতি রাতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ঘুমের অভাব হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঘুমের সময় শরীরের কোষগুলো মেরামত হয় এবং মস্তিষ্ক তথ্য প্রক্রিয়া করে। অধ্যাপক জেমস ম্যাথুস বলেন, “ঘুমের অভাবে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয় এবং সৃজনশীলতা হ্রাস পায়।”
ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণের ক্ষতিকর প্রভাব স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূমপান ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগের প্রধান কারণ। ধূমপানের ফলে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমা হয়, যা কোষ ধ্বংস করে।
অ্যালকোহলও একইভাবে লিভার, কিডনি এবং মস্তিষ্কের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অধ্যাপক রিচার্ড হোপের মতে, “ধূমপান এবং অ্যালকোহল পরিত্যাগ করা শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকে উন্নত করে না, এটি জীবনের গুণগত মানও বাড়ায়।”
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা অনেক সময় কঠিন মনে হতে পারে, তবে এটি সম্ভব। প্রথমে ছোট ছোট পরিবর্তন দিয়ে শুরু করুন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন সকালে হাঁটা, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা। মনোযোগ দিন ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর, যেমন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো এবং জেগে ওঠা। অধ্যাপক সারা জনসনের মতে, “ছোট ছোট অভ্যাসগুলো ধীরে ধীরে বড় পরিবর্তনে রূপ নেয়।”
জীবনধারণের অভ্যাস আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন, এবং পর্যাপ্ত ঘুম জীবনের গুণগত মান বাড়ায়। ধূমপান এবং অ্যালকোহল পরিত্যাগ করা এবং ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তোলা দীর্ঘমেয়াদী সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিনের ছোট ছোট পরিবর্তনই একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পথপ্রদর্শক হতে পারে।