২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সে একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এই বছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন মোট ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর রেমিট্যান্সের এই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ববাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে সহায়ক হবে।
পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই বিশাল বৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়। ২০২৩ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৩.১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার কম ছিল। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রায় ১৭% বৃদ্ধি ঘটেছে। একইভাবে, ২০২২ সালে এই পরিমাণ ছিল ২১.৫ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে।
বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ শুধুমাত্র বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলে। প্রবাসী শ্রমিকরা যারা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, মালয়েশিয়া, এবং অন্যান্য দেশে কর্মরত, তাদের পাঠানো অর্থ বাংলাদেশের পল্লী ও শহরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য রেমিট্যান্স একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সহায়তা হিসেবে কাজ করে।
বিশ্ব অর্থনীতির ওঠানামা, বিশেষত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের হ্রাসের মধ্যে রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই বৃদ্ধির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, এই রেমিট্যান্স প্রবাহের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার চলতি হিসাবের ঘাটতি কমাতে এবং আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করতে আরও সক্ষম হবে।
এছাড়া, সরকার এবং ব্যাংকগুলির পক্ষ থেকে প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের জন্য সহজ এবং দ্রুত রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা এবং কর সুবিধা চালু করা হয়েছে, যাতে তারা হুন্ডি বা অন্য অবৈধ পদ্ধতির পরিবর্তে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য উৎসাহিত হন। এ কারণে, ২০২৪ সালে প্রবাসীরা আরও বেশি সংখ্যায় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের অর্থ পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির পিছনে প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হলো আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদার বৃদ্ধি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি চাহিদা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা উচ্চতর দক্ষতা ও ভালো চাকরি পাচ্ছেন, যার ফলে তারা আরো বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহিনুর রহমান বলেছেন, “২০২৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা। এর ফলে দেশের ভোক্তাবাজারে পুঁজি বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তবে, এই প্রবৃদ্ধিকে দীর্ঘমেয়াদে বজায় রাখতে আমাদের প্রবাসীদের কর্মপরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে।”
একইভাবে, দেশীয় অর্থনীতির বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সোহেল পারভেজ বলেছেন, “রেমিট্যান্স শুধু আর্থিক অবদান নয়, এটি বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠান, তা তাদের পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই প্রবাহকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর জন্য সরকারি নীতির উন্নতি প্রয়োজন।”
এখন, ২৭ বিলিয়ন ডলার বা ২৭,০০০ মিলিয়ন ডলারকে ৩৬৫ দিনে ভাগ করলে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে আসছে। এটি দেশে একটি গড় পরিমাণ, যা দিনে দিনে দেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই পরিমাণ অর্থ যদি প্রতিদিনের হিসাব করা হয়, তা দেশের ভোক্তা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ সরকারের সামনে আগামী দিনগুলিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখার জন্য আরও কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পাশাপাশি, বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে এবং প্রবাসীদের জন্য আরও উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললে, রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে।