ঢাকামঙ্গলবার , ৮ আগস্ট ২০২৩
  • অন্যান্য

২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০% নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ৮, ২০২৩ ১২:৩৯ অপরাহ্ণ । ২৯০ জন

বায়ুমান এবং জ্বালানী উন্নয়নে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০% ক্লিন এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। কারণ এটা নিশ্চিত সম্ভব হলে দেশের বায়ুমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত গাইডলাইন অনুযায়ী হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।

গত  শনিবার, ০৫ই আগস্ট ২০২৩ সকাল ১০ ঘটিকায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এর নসরুল হামিদ মিলনায়তনে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), বারসিক এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর যৌথ আয়োজনে “বায়ুমান এবং জ্বালানী উন্নয়নে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারের” দাবিতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল পরিবেশ উদ্যোগ, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি), বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) এবং সেন্টার ফর ল’ এন্ড পলিসি এফেয়ার্স (সিএলপিএ)।

সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস এর সভাপতিত্বে উক্ত সংবাদ সম্মেলন এ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বারসিক এর সমন্বয়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশর আরবান প্রোগ্রামের টেকনিক্যাল কোঅর্ডিনেটর ডমিনিক সেন্টু গমেজ, সেন্টার ফর ল’ এন্ড পলিসি এফেয়ার্স (সিএলপিএ) এর সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর অ্যাডভোকেট রাশেদুজ্জামান মজুমদার, ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান, বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) এর সদস্য সচিব মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, বারসিক এর প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুজ্জামান সাগর, পরিবেশ উদ্যোগ গবেষণা সমন্বয়ক ইঞ্জি. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী এবং সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিইড) এর নির্বাহী পরিচালক আব্দুল ওয়াহাব।

মূল বক্তব্যে ক্যাপস এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বায়ুমান এবং জ্বালানী উন্নয়ন উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি বায়ুমানের ব্যাপক অবনতির কারণ হতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলার জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করলে পারলে দেশের বায়ুমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত গাইডলাইন অনুযায়ী হবে বলে তিনি আশাবাদী।

তিনি তার বক্তব্যে ৫টি সুপারিশ প্রদান করেন :

  • ভবিষ্যতে বায়ু দূষণের মারাত্মক প্রভাব হ্রাস করার জন্য নতুন প্রণীত বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ এ কমপক্ষে পূর্ববর্তী মান প্রতিঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম বজায় রাখার সুপারিশ করেন।
  • তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে সহযোগিতা প্রদানকারী দেশগুলো নিজ দেশে যেভাবে ইমিশনের মানমাত্রা মেনে চলে, একইভাবে বাংলাদেশেও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মান মাত্রা বজায় সুপারিশ করেন।
  • কম সালফারযুক্ত (৫০ পিপিএম) ডিজেল আমদানি ও ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।
  • পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩ এ সকল কয়লা, তেল ও গ্যাস ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্টকে পূর্বের মত (পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭) লাল শ্রেণীভুক্ত রাখার সুপারিশ করেন।
  • মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কপ২৬ এর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০% ক্লিন এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে এখন নিশ্বাসের মাধ্যমে ভারী ধাতু মানব দেহের রক্তে মিশে যাচ্ছে। জৈব জ্বালানীর দহনে বায়ুতে বিভিন্ন প্রকার‍ দূষক নির্গত হয় যা মানব শরীরের জন্য অতন্ত্য ক্ষতিকর। বিদ্যুৎ বিভাগ ও স্রেডার উচিত নবায়নযোগ্য শক্তিকে আরও বেশী প্রসারিত করা।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের আরবান প্রোগ্রাম এর টেকনিক্যাল কোঅর্ডিনেটর ডমিনিক সেন্টু গমেজ বলেন, নির্মল বায়ুতে বেঁচে থাকা সকল মানুষেরই অধিকার, যা নিশ্চিত করা সরকারের একটি অন্যতম দায়িত্ব এবং যা না হলে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে বড় বড় শহরাঞ্চল বা মেগা সিটি গুলোতে বিশুদ্ধ বা নির্মল বায়ুর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষত্রে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও অর্থনীতির চাকার অচল রাখতে আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।

বারসিক এর সমন্বয়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নগরের বায়ুর মান ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য শুধু ক্যাপসের মত গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়, এইক্ষেত্রে যুব সমাজের পাশাপাশি অন্যান্যদের ও এগিয়ে আসতে হবে। বায়ু দূষনের উৎস গুলো চিহ্নিত করে দূষণ দমনের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সবার জন্য বাসযোগ্য নগর গড়ে তোলার জন্য জলাভূমি পুনঃরুদ্ধার, নগর বনায়ন বৃদ্ধি করতে হবে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে যেমন কেউ চায় না, তেমনি নিঃশ্বাস টাও নিতে চাই নির্মল বাতাসে। আর এই দুটোই একসাথে সম্ভব নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমেই কারণ সূর্যটা অফুরন্ত।

সিএলপিএ এর সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে। এমতবস্থায় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য ও দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি; এর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি নিশ্চিত অপরিহার্য। স্বল্প মেয়াদে নগর কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত নির্মাণ কাজের দূষণ বন্ধ করা, যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ বান্ধব গণ পরিবহনের ব্যবস্থা করা।

ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, কুইক রেন্টালসহ দেশের বিভিন্ন জীবাশ্ম বিদ্যুৎভিত্তিক জ্বালানি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিগত বছরগুলোতে যে পরিমাণ ব্যয় করা হয়েছে, সেটা তুলনা করলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও গবেষণা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনায় বায়ু দূষণ কমানোর অঙ্গীকার থাকলেও উন্নয়ন উদ্যোগ ও কর্মকান্ডসমূহ আমাদের বায়ুমানের আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। বায়ু দূষণ বিধিমালা ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় বায়ুমানমাত্রার শিথিলতা এবং কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিল্পকারখানার শ্রেণী লাল থেকে কমলা শ্রেণীতে নামিয়ে নিয়ে আসা জনস্বাস্থ্যগত বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে, যা অনতিবিলম্বে পরিবর্তন করবার উদ্যোগ নেয়া উচিত।

বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) এর সদস্য সচিব মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানী শুধুমাত্র বায়ুদূষণই করে না, এটি জলজ পরিবেশ দূষণের জন্যও দায়ী। উপকূলীয় অঞ্চলে টাইডাল ও উইন্ড এনার্জির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানীর পরিমান বৃদ্ধির জন্য কাজ করা।

পরিবেশ উদ্যোগ এর গবেষণা সমন্বয়ক ইঞ্জি. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী বলেন, পরনির্ভরশীল অনবায়নযোগ্য শক্তির উপর ভরসা না করে, আমাদের উচিত ব্যক্তিগত, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে জ্বালনী চাহিদা পূরণ করা। গণসচেতনা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সোলার বিদ্যুৎ এর মত সহজলভ্য প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে হবে এতে করে নিজ নিজ বিদ্যুৎ মেটানোর পাশাপাশি নেট মিটারিং ব্যবস্থায় জাতীয় গ্রীডে অবদান রাখা সম্ভব।

বারসিক এর প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুজ্জামান সাগর বলেন, ইনডোর ও আউটডোর বায়ু দূষণ উভয়ই মানবস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। ঢাকা সহ বিভিন্ন নগর অঞ্চলে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর রান্না ও রাতের বেলা আলোর জন্য কাঠ বা বায়োমাস পোড়ায় এটি গৃহস্থ বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস, যা থেকে তাদের স্বাস্থঝুঁকি বাড়ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেহেতু পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয় সাশ্রয়ী তাই নগর দরিদ্রদের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিইডি) এর নির্বাহী পরিচালক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে, আমরা বায়ুতে নির্গত ক্ষতিকারক দূষকের পরিমাণ হ্রাস করতে পারি এবং মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব হ্রাসও করতে পারি।

উক্ত সংবাদ সম্মেলন আরও উপস্থিত ছিলেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর গবেষক ইঞ্জি. মারজিয়াত রহমান, এবং সেইভ ফিউচার বাংলাদেশ এর প্রধান সমন্বয়ক নয়ন সরকার। এছাড়াও ক্যাপস গবেষণা সহকারী, বারসিক এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর প্রতিনিধিগণ সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংস্থার সদস্যবৃন্দ।