পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মাটির গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতির বিষয়টি জেনেও তামাক চাষে ঝুঁকছেন উত্তরের কৃষক। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃষি বিভাগের উদাসীনতা, উৎপাদনের আগে কোম্পানির তামাকের দর নির্ধারণ, বিক্রয়ের নিশ্চয়তা, চাষের জন্য সুদমুক্ত ঋণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, পরামর্শ দানসহ সাত কারণে ফসল ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষক।
কৃষক বাদশা মিয়া গত বছর ৫০ শতকে আলু ও ৩০ শতকে তামাক চাষ করেছিলেন। এবার তিনি মাত্র ১০ শতকে আলু ও দেড় একরে তামাক চাষ করেছেন। আলু ছেড়ে তামাক চাষ বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে বাদশা বলেন, ‘আলু যখন খেত থাকি ওঠাই, তখন দাম পাই না। আলু চাষে বহুত টাকা লাগে। বীজের কেজি ৫০ টাকা, ওই জন্য আলু চাষ করি নাই। তামাক চাষে তেমন টাকা লাগে না, একটু পরিশ্রম বেশি হয়। কোম্পানির সুবিধাও আছে। ওই জন্য এবার আলু ছাড়ি তামাক নাগাছি।
রংপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয় তারাগঞ্জ উপজেলায়। কৃষক বাদশা মিয়ার বাড়ি তারাগঞ্জের মেনানগর গ্রামে। তিনি জানান, ৫০ শতকে আলু রোপণ থেকে উত্তোলন পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা লাগে। আছে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি। আলু উত্তোলনের পর মাঠে ভালো দাম থাকে না। মহাজনের ঋণ শোধ করতে বাধ্য হতে হয় মাঠেই আলু বিক্রি করতে। সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করে সামান্য লাভ পান। কিন্তু তামাক চাষে কোনো মূলধন লাগে না। কোম্পানি ঋণ হিসেবে বীজ, সার, কীটনাশক দেয়। মাঠে এসে দাঁড়িয়ে থেকে তামাক খেত তদারকি করে। বেশি দামে কিনেও নেয়। লোকসানের টেনশন নেই।
ক্ষতিকর জেনেও এবার ১ একরে তামাক চাষ করেছেন ইকরচালীর প্রামাণিকপাড়া গ্রামের লাল মিয়া। মাটিয়ালপাড়ার মাঠে পাঁচজন শ্রমিক নিয়ে তামাক পাতা ভাঙছিলেন তিনি। এ সময় লাল মিয়া বলেন, ‘তাংকু (তামাক) চাষ না করি, কী করি কন? আলু চাষ করলে ক্যাশ টাকা নাগে। এক কেজি আলুর বীজ ৭০ টাকা উঠছে। দাম বেশি পাবার গেইলে হিমাগারোত থুবার নাগে। তাংকু ভাঙি শুকি বাড়িত যেকোনো জায়গাত ফেলে তুইলে মাসের পর মাস থাকে। দাম বাড়লে ইচ্ছেমতো বেচা যায়। কোম্পানির সার, বীজ, লোন সুবিধা তো আছে। ওই জন্য তাংকু নাগাছি।’
কৃষক, কোম্পানি ও তামাকবিরোধী সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, রংপুরে এবার ১ হাজার ৮৪০ হেক্টরে তামাকের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে তারাগঞ্জে চাষ হয়েছে ৯৬০ হেক্টরে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জানান, তামাকের বহুল ব্যবহার হৃদ্রোগ, ক্যানসার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক অপ্রতিরোধযোগ্য রোগ ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
রংপুর সদরে নিয়োজিত জাপান টোব্যাকোর একজন মাঠ সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তামাক চাষের আগেই কৃষকদের বীজ, সার সরবরাহ করা হয়। বিনা সুদে কোম্পানি থেকে ঋণও পান কৃষকেরা। উৎপাদনের পর যখন তাঁরা কোম্পানিতে তামাক দেন, তখন কোম্পানি ঋণের টাকা কেটে নিয়ে কৃষকদের টাকা ব্যাংক হিসাবে পাঠায়।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে উঠান বৈঠক, সচেতনতা সভা করা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর প্রলোভন ও নানা সুবিধার কারণে এসব এলাকায় কৃষকেরা তামাক চাষ করছেন।