শুল্ক কমানোর পরও চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই। ফলে বাজারে চালের দাম কমছে না। এই পরিস্থিতিতে আমদানি বাড়াতে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। গতকাল কমিশন থেকে এ বিষয়ক চিঠি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া হয়েছে।
তবে আমদানিকারকরা বলছেন, বন্যায় এবার ধানের ফলন ব্যাহত হয়েছে। ফলে চালের দর কিছুটা বাড়তি। এই পরিস্থিতিতে শুল্ককর প্রত্যাহারের চেষ্টাটি সরকারের ভালো উদ্যোগ। তার পরও আমদানি হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ বিশ্ববাজারে এখন চালের দাম বেশি। দেশীয় চাল বাজারে আসতে সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। তখন দাম কমতে শুরু করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চিঠিতে চালের বর্তমান বিশ্ব ও স্থানীয় বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন বলেছে, স্থানীয় বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে সুনির্দিষ্ট মেয়াদে চাল আমদানিতে শুল্ককর সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এবার বছরের শুরু থেকেই চালের বাজার চড়া ছিল। ছাত্র আন্দোলনের সময় তা আরও বেড়ে যায়। এর পর দাম আর কমেনি। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার খুচরা বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৮ থেকে ৬৩ টাকায়। মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায়। এ ছাড়া চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে কেজি ৭২ থেকে ৮০ টাকা দরে। দুই-আড়াই মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০, মাঝারি চাল ৫৪ থেকে ৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
সরকারি সংস্থা টিসিবি বলছে, গত এক মাসে মোটা চালের দর বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ। এ ছাড়া চিকন ও মাঝারি চালের দর বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। তবে এক বছরের ব্যবধানে এই হার হারও বেশি। এ সময় সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ। বর্তমানে চাল আমদানি পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শুল্ককর রয়েছে।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে চালের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে মাস খানেক আগে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানিতে শুল্ককর ৫ শতাংশ করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্যারিফ কমিশন প্রস্তাব দিলে গত ২০ অক্টোবর এনবিআর বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ৩৫ শতাংশ শুল্কছাড় দেয়। তখন এনবিআর হিসাব করে জানায়, শুল্ক ছাড়ের ফলে প্রতি কেজি চাল আমদানিতে খরচ কমবে ১৪ টাকা ৫০ পয়সা। তবে শুল্ক ছাড়ের এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও ব্যবসায়ীদের চাল আমদানিতে আগ্রহ নেই।
তাদের ভাষ্য, ভারত থেকে সেদ্ধ চাল আমদানি করলে প্রতি কেজিতে খরচ পড়বে ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা। থাইল্যান্ড থেকে আনলে খরচ পড়বে ৭৫ টাকার মতো। এর সঙ্গে পরিবহনসহ অন্য খরচ যোগ করলে তা স্থানীয় বাজারের চালের দামকে ছাড়িয়ে যাবে। ফলে তারা আমদানির পথে হাঁটছে না। তবে সরকারিভাবে মাত্র ২৬ টন চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে দেখা গেছে, এখন বিশ্ববাজারে চালের দর কিছুটা বাড়তি। সংস্থাটির হিসাবে, ভারত থেকে চাল আনলে প্রতি কেজির দর পড়বে ৫৪ টাকার মতো। থাইল্যান্ড থেকে আনলে প্রতি কেজির দর পড়বে ৬৬ টাকা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ ও মুনাফা তো আছেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য দিয়ে ট্যারিফ কমিশন বলছে, বন্যায় গত দুই মাসে ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। দাম নাগালে রাখতে কর হার সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
জানা গেছে, এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯৫৭ টন। এর মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় ৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি নিয়েছে। এ ছাড়া ৭ লাখ টন গম আমদানিরও প্রক্রিয়া চলমান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো-মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, শুল্ক পুরোপুরি কমালেও আমদানি হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিশ্ববাজারে এখন চালের দর অনেক বেশি। ভারত থেকে আমদানি করলে মোটা চালের দর পড়বে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা। তবে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে নতুন ধান এলে চালের দাম কমে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। তবে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টনের মতো, যা চাহিদার চেয়েও বেশি। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও দাম বাড়ছে কেন– জানতে চাইলে চালকল মালিক আব্দুর রশিদ বলেন, উৎপাদন ও চাহিদা পরিসংখ্যান ভালোভাবে হিসাব করা দরকার। পাশাপাশি খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে সরকারকে তদারকি জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, চিঠি পাওয়ার পর শুল্ককর প্রত্যাহার করা যায় কিনা, সে বিষয়ে এনবিআর পর্যালোচনা করবে।