ইলেক্ট্রিক বা ই-সিগারেট কী সেটা হয়তো বর্তমানে দীর্ঘ সংজ্ঞাকারে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। ইতোমধ্যে চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অনেকেই দেখেছেন। বর্তমানে সারাবিশ্বের প্রায় ৪০টির বেশি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে এশিয়ার বিজনেস হাব খ্যাত হংকং ই-সিগারেটকে নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকাতেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের সতর্কতার পর দেশটির অনেক রাজ্যও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রধান কারণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
সম্প্র্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুটেস মেডিকেলের একদল গবেষক জানিয়েছেন, ই-সিগারেট মস্তিষ্কে মারাত্বক প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, ই-সিগারেটের কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ই-সিগারেটের তীব্র ধোঁয়া ও রাসায়নিকের প্রভাবে রোগ-প্রতিরোধকারী কোষ অকার্যকর হয়ে ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন হতে পারে। একইসঙ্গে সাধারণ সিগারেটের মতোই ই-সিগারেটেও থাকে ক্ষতিকর ও আসক্তি সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ‘নিকোটিন’তাই এটাও নেশায় রূপ নেয়।
অন্যদিকে ‘জার্নাল অব অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ’-এ ছাপা এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ‘তামাকযুক্ত সিগারেট সেবনকারীদের তুলনায় ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি এবং করোনাকালে সেটির মাত্রা বেশি হওয়ার আশঙ্কা অনেক’। করোনাকালীন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে ধূমপায়ীরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে সহজেই অনুমান করা যায় ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা কতোটা বিপদের সম্মুখীন।
ওই গবেষণা দলের সদস্য চিকিৎসক ফারিবা রেজায়ি জানান, ‘ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের পরবর্তী সময়ে ফুসফুসের সমস্যা আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়’! অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, ২০২০–এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ই-সিগারেট ব্যবহার করে ফুসফুসজনিত জটিলতা নিয়ে ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে ২০১৯ সালে নিউইয়র্ক ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করে।
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে ই-সিগারেট নিয়ে কেনো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন? এর প্রধান কারণ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া। দেশে বর্তমানে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনো ধরনের তামাক সেবন করেন৷ তরুণদের মধ্যে কথিত আধুনিকতা ও কোম্পানির প্রচারণায় পড়ে ই-সিগারেট গ্রহণের মাত্রা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০১১ সালে বৈশ্বিকভাবে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ৭০ লাখ। যেটা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ কোটি ১০ লক্ষ। বাজার বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর বলেছে, ২০২১ সালে বিশ্বে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশেও ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক। কারণ ২০১৭ সালের এক হিসাব অনুযায়ী সেসময় দেশে ই-সিগারেট ব্যবহারীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ। ফলে গত চার বছরে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণে কাছাকাছি হয়েছে বলেই অনুমান করা যায়। কারণ দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যে হারে অনলাইনে ই-সিগারেট বিক্রি ও বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তাতে তরুণদের আকৃষ্ট না হয়ে কোনো উপায় নেই। ‘দারাজ’, ‘আজকের ডিল’ ‘অথবা ডটকম’সহ দেশের খ্যাতনামা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ২৫০ টাকা থেকে ৯০০০ টাকার ই-সিগারেট ও ই-সিগারেটের নানা উপকরণ বিক্রি করছে। দেশে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় দারাজের মতো খ্যাতমান ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও দেদারসে ই-সিগারেট বিক্রি করছে। একইসঙ্গে বিক্রি ও গ্রহণ নিষিদ্ধ না হওয়ায় এর মান নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারিতেও সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নেই।
২০১৯ সালে ভারতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ হলে বাংলাদেশও আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে সে উদ্যোগ আজও সফল হয়নি। ফলে অনলাইনসহ যত্রতত্র বিক্রির পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে ই-সিগারেটের যন্ত্র ও এর উপাদান কিনতে পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে ভ্যাপিং ক্লাবও। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও চলছে নানা কোম্পানির তৎপরতা। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ই-সিগারেটের বাণিজ্য। তাই ব্যপক ব্যবহার হওয়ার আগে শুরুতেই এটার বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ জনপ্রিয় হয়ে গেলে তখন বন্ধ করা কঠিন হবে।
তবে আশার কথা হলো, সম্প্রতি দেশের ১৫৩ জন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত একটি চিঠিতে বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছেন। তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। তবে অতি দ্রুত যদি ই-সিগারেট বিক্রি-উৎপাদন-বিপণন ও গ্রহণ নিষিদ্ধ না করা হয় তাহলে এটা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন বিপদের কারণ হবে।
লেখক : প্রজেক্ট অফিসার, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি