ঢাকামঙ্গলবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জনসংখ্যা সংকট: পৃথিবীর বদলে যাওয়া জনপরিসংখ্যান ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

রঞ্জন কুমার দে
ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫ ৫:০৯ অপরাহ্ণ । ১০ জন

রাতুলের দাদুর মুখে শোনা গল্পটা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। ১৯৭০-এর দশকে দাদু যখন তরুণ, তখন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই শিশুদের কোলাহল লেগেই থাকত। ছেলেমেয়েদের হাসি-আনন্দে গ্রাম ছিল প্রাণচঞ্চল। কিন্তু সময় বদলেছে। আজ সেই গ্রাম অনেকটাই নিস্তব্ধ। নতুন শিশুর জন্ম কমে গেছে, আর অনেক তরুণই ভালো ভবিষ্যতের আশায় শহর বা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এই দৃশ্য শুধু বাংলাদেশের গ্রামেই নয়, সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশ এবং জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো ক্রমাগত জনসংখ্যা হ্রাসের মুখোমুখি হচ্ছে।

নিম্ন জন্মহার: ভবিষ্যতের শূন্যতা

বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো নিম্ন জন্মহার। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো—যেমন বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া—এই সমস্যার শীর্ষে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশেই জন্মহার প্রতি নারী গড়ে ১.৫ সন্তানের নিচে নেমে এসেছে, যেখানে জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য ২.১ হওয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মানুষ দেরিতে পরিবার গঠন করছে, সন্তান নেওয়ার আগ্রহ কমছে।

বাংলাদেশেও জন্মহার কমছে, যদিও এখনও তা স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রতি নারী গড়ে ৪.৩ সন্তান জন্ম দিতেন, যা ২০২৩ সালে কমে ২.০৫-এ নেমে এসেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও নিম্ন জন্মহারের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।

অভিবাসন বৃদ্ধি: কাজের সন্ধানে দেশান্তর

পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ ইউরোপের অনেক দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজের সন্ধানে উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। বিশেষ করে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, মোল্দোভা, আলবেনিয়ার মতো দেশগুলোতে তরুণ জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে শ্রমশক্তির অভাব সৃষ্টি হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে। যদিও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীদের দেশত্যাগ ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

বৃদ্ধ জনসংখ্যা: বার্ধক্যের ভার
জাপান, ইতালি, জার্মানির মতো দেশগুলোতে বার্ধক্যের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাপানে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৯%, যা শ্রমশক্তির ঘাটতি সৃষ্টি করছে এবং স্বাস্থ্যসেবার ওপর ব্যাপক চাপ ফেলছে। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন ও গ্রীসের মতো দেশগুলোতেও।

বাংলাদেশেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী ৮% হলেও ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ২০%-এ পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: উন্নয়নের অন্তরায়
জনসংখ্যা হ্রাসের পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ইউক্রেন, বসনিয়া, মোল্দোভা, জর্জিয়ার মতো দেশগুলোতে যুদ্ধ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সংকট মানুষের দেশত্যাগের অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশে যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হয়েছে, তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, এবং বৈষম্য অনেককে বিদেশে কাজের জন্য উত্সাহিত করছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সমাধানের পথ
জনসংখ্যা নীতির পুনর্বিন্যাস: জন্মহারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য পরিবার পরিকল্পনার কৌশল পরিবর্তন করা দরকার। উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যে নতুন পরিবার গঠনে উৎসাহ দিতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: দেশের ভেতরে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ তৈরি করতে পারলে দক্ষ কর্মীদের দেশত্যাগ রোধ করা সম্ভব হবে। বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা: স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন: অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহার
রাতুলের দাদুর মতো অনেকেই একসময় শিশুদের কোলাহলে মুখর গ্রাম দেখেছেন, কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। ইউরোপ, জাপান ও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে। তবে সময় থাকতেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে ভবিষ্যতের সংকট এড়ানো সম্ভব। জনসংখ্যা একটি দেশের শক্তি, তবে সেটি ধরে রাখতে হলে সঠিক নীতিমালা ও কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে।