ঢাকামঙ্গলবার , ১২ ডিসেম্বর ২০২৩
  • অন্যান্য

কামরাঙ্গীরচরে প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে টাইলস্সহ ব্যবহার্যপণ্য উৎপাদন

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডিসেম্বর ১২, ২০২৩ ২:৪০ অপরাহ্ণ । ২৫০ জন

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীর্ণ আদি বুড়িগঙ্গার দুই পাশ যেনো প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়। শুধু এই এলাকারই নয়, রাজধানীর অনেক এলাকার বর্জ্য এখানে ফেলা হচ্ছে। চারপাশটা এতটাই দুর্গন্ধ যে, নাক-মুখ চেপেও পথচলা কষ্টকর। এখানেই কাজ করছে একদল শ্রমিক। যারা ফেলে দেওয়া নানা বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করছে। এই ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য থেকেই পরবর্তীতে উৎপাদন হচ্ছে পরিবেশবান্ধব টাইলস্সহ বিভিন্ন পণ্য। উত্পাদিত টাইলস্ রাস্তার পাশে ফুটপাত, গাড়ি পার্কিংয়ের গ্যারেজে, ছাদ বাগানে চলাচলের পথ তৈরিসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, উত্পাদিত এইসব পণ্য ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জ্যকে আটকে রাখছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুধু কামরাঙ্গীরচর এলাকাতেই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পণ্য উত্পাদনে প্রায় ৩ হাজার কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে সব কারখানাই পরিবেশবান্ধব নয়। ফলে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের রয়েছে নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এছাড়া কারখানাগুলোও টেকসইভাবে গড়ে না ওঠায় তারা উন্নত কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হিমশিম খাচ্ছে। আর এ বিষয়েই কাজ করছে রিসোর্স ইনটিগ্রেশন সেন্টার (রিক)। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সার্বিক সহায়তায় রিকর সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের আওতায় (এসইপি) ছোট ও মাঝারি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) টাইলসের মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে শুরু থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করছে। সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগ এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কারখান সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, প্লাস্টিক থেকে টাইলস্সহ বিভিন্ন ব্যবহার্যপণ্য তৈরি করা হচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে টাইলস্ তৈরি করা হোসেইন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী নাজির হোসেইন বলেন, মাটি দিয়ে যদি টাইলস তৈরি করা যায়। তাহলে কেন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা যাবে না। এছাড়া এখানে প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগার থাকায় আমার মনে হলো এটা গলিয়ে সহজেই টালইস্ তৈরি করা সম্ভব। পরে নিজেই ছাঁচ তৈরি করে টাইলস বানিয়ে ফেললাম।

তিনি আরও বলেন, দেশে এতো প্লাস্টিক বর্জ্য আছে যে, কাঁচামালের কোনো অভাব হবে না। এছাড়া, প্লাস্টিকের টাইলসগুলো ওজনে হালকা এবং মাটি বা সিরামিকের টাইলসের চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে। এগুলো পরিবহন ও স্থাপন করা সহজ। সংশ্লিষ্টরা জানায়, বিশ্বে প্লাস্টিক টাইলসের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। ইতিমধ্যে ভারত, মিশর, কেনিয়াসহ আরো কিছু দেশ এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করেছে।

কামরাঙ্গীরচরে প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে নানা পণ্য তৈরির আরেক কারখানা মেসার্স ইউসুফ সেনিচারী। এই কারখানার স্বত্বাধীকারী ইউসুফ বলেন, তিনি প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে টয়লেটের প্যান, পিভিসি পাইপ, চারা গাছ রাখার ট্রেসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। তার এসব পণ্য ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে তার কারখানা এত পরিবেশবান্ধব ছিল না। কিন্তু এখন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া, ফিনিশড্ পণ্য, কাঁচামাল ইত্যাদি রাখার জন্য পরিকল্পনামতো কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি বলেন, পণ্যের কোয়ালিটি মানোন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমিকদের নিরাপত্তায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান তিনি।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও দূষণ, উভয়ের পরিমাণই খুব দ্রুত বাড়ছে। ১৫ বছরের ব্যবধানে প্লাস্টিকের ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে। দেশের নগর অঞ্চলে ২০০৫ সালে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৩ কেজি । যা ২০২০-এ বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৭০ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা হয় একবার ব্যবহার উপযোগী পণ্য, যেমন শপিং ব্যাগ, প্যাক করার উপকরণ ও র্যাপার নিয়ে। জাতীয় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল করা, ২০২৬ এর মধ্যে ৯০ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য থেকে সরে আসা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের (রিক) প্রজেক্ট ম্যানেজার আশফাকুর রাহমান আশা বলেন, দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবসার ও এর বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে। যা আমাদের পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও বাস্ততন্ত্র বিনষ্ট করছে। এ প্রেক্ষাপটে প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেলিং উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। তবে রিসাইকেল প্রক্রিয়াটিকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্যই আমরা কাজ করছি।