ঢাকাবুধবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • অন্যান্য

দূষণের বিপদে সুন্দরবন

নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪ ১:২৮ অপরাহ্ণ । ১৪৭ জন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। নারা কারণে সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে দূষণ বাড়ছে। বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন ও পর্যটকদের উপস্থিতি বাড়ায় দূষণ হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বনের গাছপালা, বন্য প্রাণী ও জলজ প্রাণীর ওপর। এ কারণে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই বনের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সুন্দরবন দিবস পালিতে হবে। ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সুন্দরবনসংলগ্ন জেলাগুলোতে বেসরকারিভাবে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন এবং টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে। পরে ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি সুন্দরবন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মৌজাগুলোর নাম সন্নিবেশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু এ এলাকায় গত ১০ বছরে গড়ে শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা বনের নদী ও মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর পানি ও বনের মাটিতে দূষণ বেড়েছে। সে কারণে অনেক স্থানে আগের মতো এখন গাছের চারা জন্মাচ্ছে না।

দীর্ঘদিন ধরে মোংলা বন্দর থেকে বনের মধ্য দিয়ে কয়রার আংটিহারা এলাকা দিয়ে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচল করছে। এসব জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ, হাইড্রোলিক হর্ন ও নৌযানের লাইটের আলোতে বন্য প্রাণীদের সমস্যা হচ্ছে। নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি। বেশ কিছু জাহাজ ও ট্যাংকারডুবির কারণেও দূষণ বেড়েছে।

গত ১০ বছরে ডুবে যাওয়া ৩৬টি জাহাজের মধ্যে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পশুর, শেলা ও ভোলা নদীতে ডুবেছে ২১টি। এ ছাড়া ১৫টি ডুবেছে খুলনা-যশোরের বিভিন্ন নদীতে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর পানি ও বনের মাটিতে দূষণ বেড়েছে। সে কারণে অনেক স্থানে আগের মতো এখন গাছের চারা জন্মাচ্ছে না। এ ছাড়া নদের পানিতে তেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ প্রাণী। তিনি বলেন, যেসব রুটে নৌযান চলাচল করে, তার দুই পাশে বনের মধ্যে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী দেখা যায় না।

রোগবালাই বাড়ছে সুন্দরবনের গাছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছে অনেক গাছ। এ রোগব্যাধির কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আ স ম হেলাল উদ্দিন আহম্মেদ সিদ্দিকী একাধিক গবেষণার বরাত দিয়ে জানান, বনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরীগাছের আগা মরা রোগ এবং ৫০ ভাগ পশুর হার্ট রট বা ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অধিক লবণাক্ত এলাকায় বয়স্ক সুন্দরীগাছ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অধিক ও মৃদু লবণাক্ত—উভয় এলাকাতেই পশুরগাছ ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ঢোর রোগে আক্রান্ত গাছের ভেতরের অংশ পচে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের আশপাশের এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এ কারণে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপসহ জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। তা ছাড়া বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার ও হরিণের মাংস বিক্রি চলছে এখনো।

বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে অন্তত ৪০ জন শিকারিকে হরিণের মাংস, চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে এক বছরে শুধু সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫১২ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা উদ্ধার করা হয়েছে।

বন বিভাগ ও মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রশাসনের অভিযানে ২৯৩টি নৌকা এবং সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ৩ হাজার ৬৬০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়েছে। ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে।

জেলেরা জানান, প্রতিবছর জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে সুন্দরবনে প্রবেশ ও মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। তবে অনেক জেলেই মাছ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞার সময়টি বেছে নেন। কারণ, ওই সময় বনে দর্শনার্থী থাকে না, নির্ভয়ে বিষ দিয়ে মাছ ধরা যায়।

জেলেরা আরো জানান, একবার কোনো খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করলে ১৫ দিনের মধ্যে ওই খালে কোনো মাছ তো পাওয়ায় যায় না। এমনকি মাছের ডিম বা পোনাও পাওয়া যায় না। এই বিষে বনের নদ–নদী ও খালের অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা পড়ছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনে করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট ও কলাগাছিতে সাতটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। ওই সব স্থানে প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। এ ছাড়া নতুন করে সুন্দরবনের আলীবান্ধা, আন্ধারমানিক, শেখেরটেক ও কালাবগীতে চলছে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরির কার্যক্রম। এরই মধ্যে কয়েকটিতে দেওয়া হয়েছে পর্যটক প্রবেশের অনুমতি।

সম্প্রতি সুন্দরবনের মধ্যে নির্মাণাধীন ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকদের জন্য স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে নানা প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে। কয়েকটি গাছ আংশিক কেটে রাখতেও দেখা গেছে। পর্যটকেরা চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানির বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, খাবারের প্যাকেট, ওয়ানটাইম প্লেট, গ্লাস বনের মধ্যে মাটি ও নদীতে ফেলে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছে পর্যটকবাহী কিছু কিছু নৌযানে। বনের মধ্যে বুঝে কিংবা না বুঝে হইচই করেন কিছু পর্যটক।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, সুন্দরবন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রাণ। ভারতের সুন্দরবনের ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ইসিএ এলাকা নির্ধারণ করে সেখানে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় না। আর বাংলাদেশের সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে ইসিএ। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। এটা মানতে হবে। তা নাহলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।