ঢাকারবিবার , ১০ মার্চ ২০২৪
  • অন্যান্য

রুপিতে লেনদেন হলেও আকুর প্রয়োজনীয়তা থাকছেই

আকুর মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তির ৯১ শতাংশই বাংলাদেশ-ভারতের

নিজস্ব প্রতিবেদক
মার্চ ১০, ২০২৪ ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ । ৯২ জন

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সদস্য দেশ নয়টি হলেও লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থাটি টিকে আছে কেবল ভারত-বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। আন্তঃআঞ্চলিক নিষ্পত্তি ব্যবস্থাটির মাধ্যমে লেনদেনের ৯১ শতাংশই হচ্ছে এ দুই দেশের মধ্যে। এক্ষেত্রে প্রধান পাওনাদার দেশ ভারত। আর শীর্ষ দেনাগ্রস্ত বাংলাদেশ।

আকুর পক্ষ থেকে প্রতি মাসেই সদস্য দেশগুলোর লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংস্থাটির সর্বশেষ সংখ্যার তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে আকুর মাধ্যমে মোট ৭৯ কোটি ৮৩ লাখ ডলার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ কোটি ১২ লাখ ডলার পাওনা বা ক্রেডিট পজিশনে ছিল ভারত, যা মোট ক্রেডিটের ৯১ দশমিক ৬০ শতাংশ। জানুয়ারি শেষে ৭২ কোটি ১০ লাখ ডলার দেনাগ্রস্ত বা ডেবিট পজিশনে ছিল বাংলাদেশ, যা মোট ডেবিটের ৯০ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলারই ভারতের পাওনা ছিল।

সাধারণত আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র (এলসি) খোলা বা নিষ্পত্তির সময় তাৎক্ষণিকভাবে দায় পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু আকুর মাধ্যমে হওয়া লেনদেন নিষ্পত্তি হয় প্রতি দুই মাস পরপর। তবে এ ক্ষেত্রেও লেনদেনের পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। আমদানি দায়ের সঙ্গে রফতানি আয় সমন্বয় করে যে দায় অবশিষ্ট থাকে, কেবল সে অর্থ পরিশোধ করতে হয়।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ—এশিয়ার এ নয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আকুর সদস্য। এর মধ্যে আর্থিক দেউলিয়াত্বের কারণে গত বছর শ্রীলংকার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের সঙ্গে আকুর মাধ্যমে লেনদেন বন্ধ রয়েছে।

আকুর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেই। ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিবেশী এ দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২৩ কোটি বা ১৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। তবে এ বাণিজ্যের মধ্যে ১২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারের পণ্যই আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আর একই সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের। এ বাণিজ্যের মধ্যে ১৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। দুই দেশের বাণিজ্যের বিপুল এ ঘাটতিই আকুর প্রয়োজনীয়তাকে টিকিয়ে রেখেছে। ভারতের সঙ্গে রুপিতে সরাসরি লেনদেন চালু হলেও সেটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অনেক সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘রুপিতে লেনদেন চালু হলেও আকুর প্রয়োজনীয়তা থাকবে। কারণ ভারতে বাংলাদেশের রফতানি হয় ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। বিপরীতে ভারত থেকে আমরা ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য আমদানি করি। ফলে রুপিতে লেনদেন পুরোপুরি চালু হলেও আকুর প্রয়োজনীয়তা সহসা ফুরাবে না। এ ব্যবস্থায় দায় দুই মাস পরপর পরিশোধ করা হয়। আর দেনাগ্রস্ত হওয়ায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা পায়।’

আকুর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে আকুর মাধ্যমে লেনদেন নিষ্পত্তির পর নিট দেনা ছিল ৭৫ কোটি ১৯ লাখ ডলার। দেনাগ্রস্ত দেশের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও নেপাল। আর ভারত, পাকিস্তান, ভুটান ও মিয়ানমার ছিল পাওনাদারের তালিকায়। মোট দেনার মধ্যে ৬৯ কোটি ৯৬ লাখ ডলারই ছিল বাংলাদেশের। লেনদেন নিষ্পত্তি শেষে ভারতের নিট পাওনা ছিল ৭২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাস তথা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির আকুর দেনা গত সপ্তাহে পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির তথ্যমতে, গত দুই মাসের আকুর দেনা বাবদ ১৩৫ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ দেনা পরিশোধের পর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (বিপিএম৬) অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে গত বছরের ১১ জুলাই রুপিতে বাণিজ্য শুরু করে ভারত ও বাংলাদেশ। ওই সময় বলা হয়েছিল, রুপিতে লেনদেন শুরু হলে ডলারের সংকট কমবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও বেশ উপকৃত হবেন। যদিও এখন পর্যন্ত রুপিতে লেনদেন করতে ব্যবসায়ীদের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ডলারের লেনদেনও রুপিতে নিষ্পত্তি হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত রুপি থাকলেই কেবল ভারতীয় মুদ্রায় আমদানির এলসি খোলা সম্ভব। কিন্তু তেমন কোনো ব্যাংকের হাতেই রুপি নেই। কারণ রুপি থাকতে হলে বাংলাদেশ থেকে এ মুদ্রায় পণ্য রফতানি হতে হবে। ভারতে যেসব বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান পণ্য রফতানি করে, সেগুলো ডলারেই মূল্য পেতে চাইছে। এ কারণে আমদানিকারকরা চাইলেও ভারত থেকে রুপিতে পণ্য আমদানি সম্ভব নয়।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রুপিতে লেনদেন শুরু হলেও সেটির ব্যাপ্তি এখনো খুবই সীমিত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এত বড় ঘাটতি রেখে রুপিতে লেনদেনের নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। আবার রুপির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাও সে অর্থে তৈরি হয়নি। দুই দেশের মধ্যে লেনদেন তখনই সহজ হতো, যখন ভারত আমাদের টাকা গ্রহণ করত। কিন্তু ভারত তো পণ্যের বিপরীতে টাকা নেবে না। তার মানে দিন শেষে আমাদেরকে ডলারেই পেমেন্ট করতে হবে। এজন্য আকুর প্রয়োজনীয়তা শিগগিরই কমবে না।’

রুপির মাধ্যমে লেনদেন শুরু হওয়াকে অবশ্য ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী। তিনি বলেন, ‘কখনো ভারতে আমাদের রফতানি আয় বাড়লে এ ব্যবস্থায় আমরা উপকৃত হতে পারব। সে ক্ষেত্রে ডলারের ওপর অতিনির্ভরতা কমে আসবে। চীন ও রাশিয়াও তাদের মুদ্রাকে ডলারের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছে। দেখা যাক, দেশ দুটি শেষ পর্যন্ত কতদূর এগোতে পারে।’