ঢাকারবিবার , ২৮ মে ২০২৩
  • অন্যান্য

ডেঙ্গুর ‘হটস্পট’ হয়ে উঠেছে কক্সবাজার

admin
মে ২৮, ২০২৩ ৭:২৬ অপরাহ্ণ । ৬৯৮ জন

মৌসুম শুরুর আগেই দেশে দ্রুত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা; ঢাকার বাইরে কক্সবাজার হয়ে উঠছে বড় ‘হটস্পট’। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১০৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর কক্সবাজারে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে এই সংখ্যা ৪২৬। অর্থাৎ, মৌসুম শুরুর আগেই এ জেলায় ১৫৩২ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা একই সময়ে ঢাকায় শনাক্ত রোগীর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়, কারণ ওই সময়ে শুরু হয় বর্ষাকাল। এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ বছর মৌসুম শুরুর আগেই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৬ জন এইডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; তাদের মধ্যে ৪১ জনই ভর্তি হয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। আর এ বছর সব মিলিয়ে ১৭৫০ জন ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১১৬০ জন ঢাকায় এবং বাকিরা ঢাকার বাইরের। এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৩ জন, যাদের দশজন ঢাকার। তবে এই পরিসংখ্যানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের তালিকা আসেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত বা মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেয়, সেখানেও রোহিঙ্গাদের তথ্য থাকে না। এর ব্যাখ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রোহিঙ্গা কমিউনিটি যেহেতু আমাদের নাগরিক না, তাদের তথ্য আমরা একসঙ্গে আনি না। তবে যেহেতু তারা আমাদের সঙ্গেই থাকে, জাতিসংঘও তাদের তথ্যটা চায়, সেহেতু গুরুত্ব দিয়েই আমরা তাদের তথ্য সংগ্রহ করি এবং আলাদাভাবে হিসাব করি।”  এ বছরের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। সেখানকার স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ছড়ানো এই সংখ্যাটাও উপেক্ষা করার মত নয়।”
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যা পরিস্থিতি, তাতে সেখানে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ‘কঠিন’ বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা। নাজমুল ইসলাম বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাদের কালচার আলাদা হওয়ায় এ ব্যাপারে কাজও সেভাবে করা যায় না। তারা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকেন, সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও অনেক নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়।” তিনি বলেন, “তাদের পরিষ্কার পানির উৎস সীমিত, তাই তারা পানি সংগ্রহ করে অনেক সময় খোলা পাত্রে রেখে দেয়, যা মশার জন্য একটা ভালো প্রজননক্ষেত্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কম জায়গায় মানুষ বেশি। ফলে সেখানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি।” ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যেখানে ঘনবসতি বেশি, সেখানে মশার উপদ্রব বেশি। তবে কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন বলে মন্তব্য করেন নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমরা পুরো ঢাকা শহরকেই বিবেচনায় নিচ্ছি। আমাদের কাজ রোগী ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু কোথায় বেশি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের।”
ডেঙ্গু বাড়ছে কয়েক কারণে, আগেই হুঁশিয়ারি
ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশার বিস্তার বাড়ার কারণ নিয়েও আলোচনা হয় সংবাদ সম্মেলনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ডেঙ্গু বাড়ার পেছেন জলাবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জনঘনত্বের মত কারণগুলো তুলে ধরেন। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, “বাংলাদেশ অনেক জনবহুল, তার ওপর এখানে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে। ফলে এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সহজ না। এরই মাঝে অপ্রত্যাশিত কিছু মৃত্যু হয়েছে। মে মাসে যেটুকু হয়েছে, তা অন্যান্য সময়ে হয়নি।” মে মাসের ২৮ দিনে সারা দেশে (রোহিঙ্গাদের তথ্য ছাড়া) ৭৬৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। এ মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। এর আগে জানুয়ার মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে যান ৫৬৬ জন, মৃত্যু হয় ৬ জনের। আর ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, “জানুয়ারি মাসের পর থেকে আমাদের অনেক গরম পড়েছে। বিজ্ঞান বলে, কোনো জিওগ্রাফিতে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে তার ডাবল পরিমাণ ডেঙ্গু কেইস চলে আসে। তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেল যখন তখন বৃষ্টিপাত, বাতাসের গতি কত ছিল তা দেখে কিন্তু অনুমান করা হয়েছে প্রাক মৌসুমেই ডেঙ্গু কেইস বেশি হবে। “ঢাকা শহর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে, ঠিক ব্রাজিলের মতই। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেই আমরা প্লাটিলেটকে সামনে আনি। অথচ এটি সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের উচিত সচেতনতায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।” সিটি করপোরেশনের সাথে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের সমন্বয় প্রসঙ্গে আহমেদুল কবির বলেন, “আমরা এরই মাঝে সিটি করপোরেশনগুলোকে জানিয়েছি, খুব দ্রুত যদি মশার স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। দুই সিটি করপোরেশনের সাথেই আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা তাদের ম্যাপিং করে জানিয়ে দিই, কোথায় বেশি ছড়াচ্ছে। “তাদের জায়গা থেকে আরেকটু বেশি অ্যাক্টিভ হতে হবে। যেহেতু আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, কোথায় কী হচ্ছে, তাই তাদের উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণ, লার্ভা ধ্বংসসহ তারা যেসব ব্যবস্থা নেন, সেগুলোর মাধ্যমে যেন আমরা ভেক্টরটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।” ডেঙ্গু চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরির সাথে যুক্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কাজী তারিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। ২০০০ সালে এটা বাংলাদেশে আসার পর মাঝে পরিস্থিতি ভালো গেছে, কোভিডের আগের বছর আমরা একটা বড় সংক্রমণ দেখেছি, গতবছর দেখলাম, আর এবার আমরা অনুমান করছি, এবারও হয়ত এমন কিছু একটা হতে পারে।”
এইডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গত বছর ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে রেকর্ড ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের।
বেসরকারিতে ডেঙ্গু পরীক্ষা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা
বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরীক্ষায় ৫০০ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না বলে হুঁশিয়ারি এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের কাছ থেকে। সরকারি হাসপাতালে এই ব্যয় হবে ১০০ টাকা। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “ডেঙ্গু পরীক্ষাসহ ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। এর গাইডলাইন অনুযায়ীই সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে। প্লাটিলেট ব্যবহার নিয়েও গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে।” বেসরকারি হাসপাতালে শনাক্ত ডেঙ্গু রোগীদের হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসার ব্যাপারে ‘অগ্রগতি হয়েছে’ বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।