চলতি এবং আগামী অর্থবছর ১০ লাখ করে ২০ লাখ টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে গম আমদানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সরকার টু সরকার (জিটুজি) চুক্তি হয়েছে। চলতি অর্থবছর যে ১০ লাখ টন গম আমদানি করা হচ্ছে তার মধ্যে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার টন গম ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে। এক লাখ ২০ হাজার টন গম চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। বাকি তিন লাখ ২৪ হাজার টন আমদানি প্রক্রিয়াধীন আছে।
চলতি অর্থবছর কেনা ১০ লাখ টন গমের মধ্যে রাশিয়া থেকে আসছে সাড়ে আট লাখ টন। এর মধ্যে ছয় লাখ টন জিটুজির মাধ্যমে এবং আড়াই লাখ টন আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করা হচ্ছে। এছাড়া বুলগেরিয়া, ইউক্রেন ও উরুগুয়ে থেকে ৫০ হাজার টন করে মোট দেড় লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছে সরকার।
এছাড়া আগামী অর্থবছর আরও ১০ লাখ টন গম কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত বছর সরকারিভাবে ছয় লাখ ৮৬ টন গম আমদানি করা হয়।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বময় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধ এ যেন জ্বলন্ত কড়াইয়ে ঘি ডালার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সারা বিশ্ব। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ওপর নজর রাখতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নির্দেশন দিয়েছেন। যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে করণীয় নির্ধারণে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে আগাম পরিকল্পনা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন বলে জানিয়েছেন। বর্ণিত পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৎপর হয়ে উঠছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন এনডিসি বলেন, বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ১২ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। নতুন করে সাড়ে ১৭ লাখ টন খাদ্যশস্য অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। তার মধ্যে ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, এক লাখ টন আতপ চাল, ৫ লাখ টন ধান এবং ৫০ হাজার টন গম কেনা হচ্ছে। দেশে ধান ও চালের কোনো সংকট নেই। ধানের উৎপাদনও ভালো। সমস্যা হচ্ছে গমের। তাই সরকার নতুন করে চলতি অর্থবছর সব মিলিয়ে ১০ লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী অর্থবছরও একই পরিমাণ গম আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ করবে সরকার। এক প্রশ্নের উত্তরে খাদ্য সচিব জানান, নতুন করে ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে জিটুজি পদ্ধতিতে গম আমদানি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সরকার টু সরকার আমদানি হলেও মাঝখানে দুদেশের কিছু ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা সুবিধা দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সে বিষয়ে খাদ্য সচিব বলেন, রাশিয়ান দূতাবাসে নিয়োগ করা লোক একজন আছে। তাকে আমি ভালো করে চিনিও না। সরকারি ক্রয়ে তার কোনো ভূমিকাও নেই। সে শুধু রাশিয়ান দূতাবাসের হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের কাজ করে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাশিয়া থেকে সরকার টু সরকার আমদানি করতে পারলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি চট্টগ্রাম বন্দরের খালাসের কাজটা করতে সমস্যা কোথায়? মধ্যস্থতাকারী লাগবে কেন। খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক একজন মহাপরিচালক জানান, আমদানি জিটুজি। কিন্তু সব টেবিলে সুবিধা দিয়েই আমদানি করতে হয়। বিষয়টি উচ্চপর্যায়ের সবাই কম-বেশি অবগত। এটা দেশের জন্য দুঃখজনক পরিস্থিতি। তিনি আরও জানান, আমি এ অনিয়ম বন্ধে সুপারিশগুলো লিখে এসেছি। কিন্তু তা মানা হয় না এবং হচ্ছে না।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রধান ফসল হচ্ছে বোরো ধান। বোরো উৎপাদনে বিদ্যুৎ ও ডিজেল খরচ হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ব্যবহার করা হয় জ্বালানি। ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে জ্বালানি পাওয়া যাবে না। তখন কিন্তু বোরো উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বিকল্প হিসাবে সরকার বর্ষা মৌসুমে উৎপাদিত ধান বিশেষ করে আমন ও আউষ ধানের চাষাবাদ বাড়াতে হবে। কারণ আউশ ও আমনে জ্বালানি খরচ নেই। সুতরাং সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, নন-ইরিগেশন ফসলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আউশ ও আমনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষককে সারের বিকল্প জৈবসার ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু আমদানি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। আগামী দিনে ডলার থাকলেও জ্বালানি ও সার পাওয়া মোটামুটি অনিশ্চিত।