ঢাকামঙ্গলবার , ৭ মে ২০২৪
  • অন্যান্য

‘বির্তকিত জিএমও গোল্ডেন রাইসের অনুমোদন বিপর্যয় ডেকে আনবে’

নিজস্ব প্রতিবেদক
মে ৭, ২০২৪ ৫:৪৮ অপরাহ্ণ । ১৪৭ জন

বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস অনুমোদন না দেয়ার দাবি জানিয়েছে উবিনীগ, বেলা, নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ, জিএম বিরোধী মোর্চা।  গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন: বাংলাদেশে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের নিরসন জরুরি’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান।

পাবলিক হেলথ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের উদ্দেশ্যে গোল্ডেন রাইস নিয়ে তাদের মূল্য প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হুবহু তুলে ধরা হলো।

গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের চেষ্টা অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। গোল্ডেন রাইস একটি জেনেটিকালি মডিফাইড ফসল। ধানের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক গঠন সংকেতে ভিন্ন ‘জিন’ জবরদস্তি প্রবিষ্ট করানো হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) এই গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ইরি) অধিনে। কাজেই এটা বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের কোন গবেষণা নয়। গোল্ডেন রাইসের মধ্যে ব্রি ধান ২৯, ফিলিপাইনে অবস্থিত আই আর-৬৪ (IR-64), এবং ফিলিপাইনের একটি জাত RC-28 এর সাথে ভুট্টার জিন ঢুকিয়ে বিটা কেরোটিন (beta carotene) যা ভিটামিন এ সৃষ্টি করা হয়েছে। ধানটির চাল সোনালী রংয়ের বলে এর নাম গোল্ডেন রাইস GR-2 E BRRI dhan29 । এর পেটেন্টধারি কোম্পানি হচ্ছে সিনজেন্তা। এর আগে ডেফোডিল ফুলে জিন ঢুকিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের National Technical Committee on Crop Biotechnology (NTCCB) ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বরে আবেদন করে। সেখান থেকে অতিদ্রুত মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের National Committee on Biosafety (NCB) কাছে পাঠানো হয়। এতে বোঝা যাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ক্রপ বায়োটেকনোলজি যথেষ্ট সময় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি।

জিএম ফসল হিশেবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি, কার্যকারিতা এবং এই ধানের আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি না এই সব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায় নি। আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে তাঁরা সময় নিয়ে এর নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করছেন এবং এখনও অনুমোদ্ন দেয়া হয় নি। কিন্তু কোম্পানি এবং উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে তাড়া দেয়া হচ্ছে। তারা সরাসরি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন।

গোল্ডেন রাইস সারা বিশ্বে বিতর্কিত। ফিলিপাইনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলা হলেও এখন তা বাতিল করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে ফিলিপিনো কৃষকরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কাজেই ফিলিপাইনের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদন নেয়ার কোন অর্থ নাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ব্রি ২৯ চাষ করেন। সেখানে কোন পেটেন্ট নাই। কৃষক এর বীজ নিজেই রাখে কিংবা বাজার থেকে কিনে নেয়। স্বাধীনভাবে তারা এই ধান চাষ করতে পারে। তাহলে এই ধানের স্বত্ত্ব বিদেশী কোম্পানির হাতে চলে গেলে বাংলাদেশের লক্ষ কোটি কৃষকের ভাগ্যে কি ঘটবে? এই প্রশ্নের জবাব কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের স্বার্থ দেখা, কোম্পানির স্বার্থ নয়।

দাবি করা হচ্ছে এবং প্রচারণা চালানো হচ্ছে গোল্ডেন রাইস ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ। বলা হচ্ছে এর মধ্যে কেরটিনয়েড রয়েছে এবং মানুষের শরীরে হজম হতে গিয়ে এটা ভাঙ্গে এবং ভেঙ্গে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। এটা অনুমান। যদি অনুমান সত্যি ধরেও নেয়া হয় তাহলে জানতে হবে এই ভাত খেলে কী পরিমান কেরোটিনয়েড ভাত থেকে আলাদা করে শরীর গ্রহণ করতে পারে এবং তা ভেঙ্গে তার রূপান্তর ঘটিয়ে কী পরিমান ভিটামিন এ বানাতে সক্ষম হয়। গোলডেন রাইস খাইয়ে দিলেই সেটা আপনা আপনি ‘ভিটামিন-এ’ হয়ে যাবে না। অথচ গোল্ডেন রাইসের সংযোজিত কেরোটিনয়েড কিভাবে এবং কি পরিমাণ ভিটামিন-এ হিসাবে মানুষের শরীর বানাতে পারবে সেই গোড়ার তথ্যের জায়গাতেই উপাত্তের অভাব রয়েছে। আরো জানা দরকার যে এই ধান ঘরে রাখলে, গুদামজাত করলে এবং রান্নার পরে শেষ পর্যন্ত কি পরিমান কেরোটিনয়েড টিকে থাকবে?  এই বিষয়ে কোনো উপাত্ত এখনো নেই। সেই তথ্য উপাত্ত ঠিক না করেই তারা ছাড়পত্রের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এটা যেন শুধু একটা কাগজের ব্যাপার। এর সাথে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, কৃষকের অধিকার সব কিছু অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ‘ছাড়পত্র’ দিলেই সেসব নিশ্চয়তা মিলবে না।

বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশান এই গোল্ডেন রাইসকে পুষ্টির একটি মাধ্যম হিশেবে দিয়ে দাতব্য ভাব দেখাতে চাচ্ছে। তারা দাবি করছে ভিটামিন-এ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগের জন্য এই ধানের ভাত খেতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন-এ পাওয়ার উৎস আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। বাংলাদেশ পুষ্টিবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায় নানা রকম কুড়িয়ে পাওয়া শাক যেমন কাঁটানটে, কলমি, সাজনা পাতা এবং আবাদী ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, পুঁইশাক, সীম, ঢেঁড়শ, ডাটার মধ্যে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে। ফলের মধ্যে পাকা পেঁপে, বাংগি, কাঠাল, আম, কলা, আনারস সহ হলুদ রংয়ের ফল গুলোতে ভিটামিন-এর কোন অভাব নেই। ঢেঁকি ছাটা চালে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়। তাহলে কেন আমরা অহেতুক আমাদের একটি প্রচলিত ধান ২৯ কে কোম্পানির হাতে তুলে দেব এবং পুষ্টির ভার দিয়ে দেবো বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশানকে? গ্রামের সাধারণ কৃষকরাই তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় এই খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন।  বাংলাদেশ ধানের আদি নিবাস। ১৯১৫ সালে এদেশে ১৫০০০ জাতের ধান ছিল।এখনো কম পক্ষে ৭৫০০ জাতের জাত ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানেই আছে, কৃষকদের হাতেও আছে ৩০০০ জাতের ধান। আমাদের কি আর অন্য ধানের দরকার আছে? এখানে কৃষক বলতেই ধান উৎপাদন করেন। কাজেই ধানের দেশে ধানের ওপর জিন কারিগরি কোন দায়িত্বশীল কাজ হতে পারে না।

যেসকল প্রশ্নের নিরসন জরুরি

আমরা সরকারের কাছে দাবি করছি বাংলাদেশে বিতর্কিত জিএম ফসল প্রবর্তনের আগে জনগণের কাছে যে সকল প্রশ্নের উত্তর পরিস্কার হওয়া দরকার, তা হচ্ছে-

১। কৃষি বৈচিত্র্যের দেশের গোল্ডেন রাইস ধান এবং বিটি বেগুন প্রবর্তনের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? এই দুটো ফসল যে কারণে করা হচ্ছে তার সমাধান আমাদের আছে।

২। জিএম ফসলের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ঝুঁকির যে সম্ভাবনা আছে বলে বিশ্ব ব্যাপী বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন এবং গবেষণা করেছেন, তার ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বারি) কোন তথ্য আছে কিনা। তারা নিশ্চিত কিনা যে এই দুট জিএম ফসল নিরাপদ। সে রকম কোন প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে কিনা।

৩। ভিটামিন এ ঘাটতির অজুহাতে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তন না করে দেশে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ্ব সবজি, ফল, শাক, ইত্যাদি উৎপাদনে সহায়তা করা হচ্ছে না কেন?

৪। ব্রি -২৯ এর পেটেন্ট সিনজেন্টা কোম্পানীকে দিয়ে দেয়া হলে দেশের কোটি কোটি কৃষকের ধানের এই জাত চাষ করা অধিকার কি ক্ষুন্ন হবে না? এই ধান বহুজাতিক কোম্পানিকে দেয়া হোল কেন?

৫। কীটনাশক ব্যবহার কমাবার কথা বলে বিটি বেগুন প্রবর্তন করা হচ্ছে অথচ ধান থেকে শুরু করে সব ধরণের হাইব্রিড ফসলে ব্যাপকভাবে কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার করা হচ্ছে? এগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না কেন?

বাংলাদেশের মানুষ, পরিবেশবিদ, এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে নিরাপদ ও পরিবেশ সম্মত খাদ্য উৎপাদনের জন্যে দাবি করছেন। বর্তমানে অসংক্রামক রোগ অত্যন্ত বেড়ে গেছে এবং সকল মৃত্যুর ৬৭% শুধু এই অসংক্রামক রোগের কারনেই হচ্ছে, যার মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম প্রধান রোগ। পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছর নতুন রোগীর সংখ্যায় বেড়ে চলেছে। জিএমও আরো নতুন স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করছে যা কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ।