ঢাকারবিবার , ৯ জুন ২০২৪
  • অন্যান্য

শিশুদের ওপর তামাক কোম্পানির প্রভাব ও করনীয়

ইব্রাহীম খলিল
জুন ৯, ২০২৪ ৩:২৯ অপরাহ্ণ । ১৪৫ জন

গত ৩১ মে ২০২৪ ছিলো বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’। শিশুদের প্রতি এবারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার প্রধান কারণ হলো, বিশ্বব্যাপী তামাক কোম্পানি তাদের ব্যবসা এমনভাবে গড়ে তুলছে এবং পরিচালনা করছে যেখানে তাদের প্রধান লক্ষ্য শিশুরা। ভবিষ্যতের ভোক্তা তৈরি করতে তামাক কোম্পানি ইতোমধ্যে নানা কূটকৌশল বাস্তবায়ন করছে। ফলে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ১২ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর ধূমপান করে। যাদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। ধূমপানে আসক্ত এসব শিশুদের ৭৫ ভাগ ছেলে আর ২৫ ভাগ মেয়ে। শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা-৪-এ বাংলাদেশে শিশুর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’ শিশুর এ সংজ্ঞায়ন অনুযায়ী হিসাব করলে ধূমপায়ী শিশুদের হার আরও বেশি হবে সেটা সহজেই অনুমেয়।

আমাদের শিশুদেরকে ক্ষতিকার তামাক ব্যবসার ভোক্তা হিসেবে দেখে তামাক কোম্পানি। অথচ এসব শিশুদের সবধরনের তামাকজনিত রোগ ও মৃত্যু থেকে মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার রয়েছে। তামাক কোম্পানিগুলো শিশুদের স্বাস্থ্যের অধিকার ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার অধিকার লঙ্ঘন করছে। এসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। সেই গুরুত্ব অনুভব করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করছে তামাক কোম্পানি। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা বাস্তবায়ন বিলম্বিত করতে প্রতিনিয়ত আইন ভঙ্গ করছে তারা।

বিশেষ করে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের শিশুদের ‘আগামীর ধূমপায়ী’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে চলেছে। বিভিন্ন দোকানে শিশুদের উচ্চতা মাথায় রেখে এমনভাবে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হয় যাতে শিশুরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে সিগারেট বিক্রি হওয়ার কারণে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপানের হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিংয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত ক্ষতির পাশাপাশি শিশুদের ধূমপায়ী হতেও ভূমিকা রাখছে।

তামাক কোম্পানিগুলো এমনভাবে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে যাতে শিশুরা চাইলেই সেগুলো কিনতে পারে এবং নিয়মিত ভোক্তায় পরিণত হয়। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তামাক কোম্পানি শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েবসিরিজসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যপকভাবে তামাকের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। কখনো দায়সারাভাবে সতর্কতা বার্তা দিলেও সেটা এমনভাবে দেয়া হয় যাতে দৃষ্টিগোচর না হয়। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় চলচ্চিত্র, নাটক ও ওয়েবসিরিজের প্রধান চরিত্রগুলো একটি বহুজাতিক কোম্পানির সিগারেট গ্রহণ করছে। ফলে শিশুরাও তাদের মতো হতে চেয়ে তামাক কোম্পানির ভোক্তায় পরিণত হচ্ছে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সবধরনের তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ। একইসঙ্গে ১৮ বছরের কম বয়সীদের কাছে সবধরনের তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করা দন্ডনীয় অপরাধ।

অথচ তামাক কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে বিক্রেতারা মানবিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে এসব দোকানের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে তাদের সেই জরিমানা তামাক কোম্পানি পরিশোধ করে দেয়। পাশাপাশি ব্যবসার জন্য বিভিন্ন উপটৌকন দেয়। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে বিশেষ করে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে বর্তমানে শিশুদেরকে তামাকজাত দ্রব্যের পাশাপাশি ই-সিগারেটের আসক্ত করতে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। বিভিন্ন ফ্লেভারের ই-সিগারেটকে সিগারেটের চেয়ে কম ক্ষতিকারক বলে শিশুদের লক্ষ্য করে ব্যবসার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। অথচ ই-সিগারেটও ভয়াবহ ক্ষতিকারণ। ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ই-সিগারেট শিশুদের জন্য ভয়াবহ। কারণ শিশুরা নতুন পণ্য ও স্বাদের পরীক্ষা করে দেখতে চায়। আমাদের অবিভাবকদের মনে রাখা দরকার, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করা শুরু করা সহজ কিন্তু ছেড়ে দেওয়া আরও কঠিন। ই-সিগারেট, ভ্যাপিং সিগারেটে থাকা নিকোটিন হেরোইনের মতোই আসক্তি তৈরি করে। মানুষের ফুসফুস ও মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু তামাক কোম্পানি শিশুদের টার্গেট করে ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার ও নানাধরনের ফ্লেভারের পণ্য বাজারজাত করছে। যা আগামী প্রজন্মকে মারাত্বক ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাক ও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ থেকে বাঁচাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ব্যাপকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। ই-সিগারেট নিষিদ্ধের পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের ভিতরে সবধরনের তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি আইন ভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিশুরা যাতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আকৃষ্ট না হতে পারে সেজন্য অতিদ্রুত এসব বিজ্ঞাপন সরিয়ে ফেলতে হবে। শিশুদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে, আইন ভঙ্গ করে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, প্রমোশন করলে দোকানদার ও তামাক কোম্পানিকে জরিমানা করতে হবে। পাশাপাশি তাদের কারাবাস নিশ্চিত করা জরুরি। এতে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আইনভঙ্গ করতে নিরুৎসাহিত হবে।

যেহেতু ওয়েবসিরিজ, ওটিটি প্লাটফর্মে ব্যপকভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও গ্রহণের দৃশ্যায়ন রয়েছে সেহেতু বাসায় এসব দেখা বন্ধ করতে হবে। বাবা-মাকেও নিজেদের বাড়িকে ধূমপান মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে। শিশুরা যাতে ধূমপায়ী বিরোধী হয়ে ওঠে এজন্য স্কুলে ধূমপান বিরোধী অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হবে। পরিবেশ, দেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে আরও মানবিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

আমরা জানি, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ এবং দন্ডনীয় অপরাধ। ফলে কোনো দোকানদার সেটা ভঙ্গ করলে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। ধারাবাহিকভাবে ভঙ্গ করতে থাকলে তাদেরকে আইনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। তামাক কোম্পানির ব্যবসার কারণে আগামী প্রজন্ম যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এজন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের শিশুদের সুরক্ষায় তামাক কোম্পানির সবধরনের হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে এবং সহযোগিতা করতে হবে।

তথ্যসূত্র

১. https://tinyurl.com/mryyxkp4

২. https://tinyurl.com/yfebk7tn

লেখক : প্রজেক্ট অফিসার, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)।