ঢাকারবিবার , ১৭ নভেম্বর ২০২৪

ডিএনসিসিতে সড়কে হতাহতদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ১৭, ২০২৪ ৯:০৮ অপরাহ্ণ । ৯০ জন

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এর উদ্যোগে সড়কে হতাহতদের [রোড ট্রাফিক ভিকটিমস] স্মরণ ও ঢাকা’র সড়ক নিরাপদ করে তুলতে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে গোলটেবিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সড়কে হতাহতদের স্মরণে বৈশ্বিক দিবস ‘ওয়ার্ল্ড ডে অফ রিমেমব্রান্স ফর রোড ট্রাফিক ভিকটিমস’ [World Day of Remembrance for Road Traffic Victims (WDoR)] উপলক্ষে আজ (১৭ নভেম্বর) সকালে নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) ও ভাইটাল স্ট্রাটেজিস এর কারিগরি সহায়তায় এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে সভাপতিত্ব করেন ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম, সঞ্চালনা করেন বিআইজিআরএস-এর ইনিশিয়েটিভ কোঅর্ডিনেটর মো. আবদুল ওয়াদুদ এবং প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভাইটাল স্ট্রাটেজিস এর কারিগরি পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন।

সভাপতির বক্তব্যে ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সড়কসমূহকে নিরাপদ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটিসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। বিশেষত, ডিএনসিসি ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস এর বৈশ্বিক সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আওতায় ঢাকা উত্তরের জনগণের জন্য নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

সম্মানিত অতিথি প্রধান প্রকৌশলী ব্রি.জে. মো. মঈন উদ্দিন বলেন, যারা মারা যায় তাদের পরিবার যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায় তা খুবই হৃদয় বিদারক। যারা ভুক্তভোগী শুধু তারাই এটি অনুধাবন করেন। ঢাকার সড়কে যারা মারা যায় তাদের বড় অংশ পথচারী, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল আরোহী। পথচারীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রশস্ত ও সমান্তরাল ফুটপাথ নির্মাণ, জেব্রা ক্রসিং অঙ্কনসহ অবকাঠামোগত উন্নতি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয় এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আমাদের এই প্রচেষ্টায় সকলের সমর্থন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বিশেষত, সড়ক ব্যবহারে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে, ট্র্যাফিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। পথচারী, সাইকেল চালক, রিকশাসহ সকল পরিবহনের যাত্রী ও চালকদের জন্য সড়ক নিরাপদ হোক। আসুন আমরা দায়িত্বের সঙ্গে গাড়ি চালাই। সড়ককে নিরাপদ হিসাবে গড়ে তুলি।

সভা সঞ্চালক বিআইজিআরএস এর ইনিশিয়েটিভ কোঅর্ডিনেটর মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, সড়কে হতাহতদের আন্তর্জাতিক দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সড়কে যারা মারা গেছেন ও পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন – তাঁদের স্মরণ, মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবার ও চিকিৎসাধীন ব্যক্তিকে জরুরি সেবা প্রদান করা, সড়ক নিরাপদ করতে গবেষণাধর্মী তথ্য ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “সেই দিন – যে দিনে রোড ক্র্যাশের কারণে পরিবারের সদস্য মারা গেছেন বা চিরতরে পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন”।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে ভাইটাল স্ট্রাটেজিস এর কারিগরি পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, আমরা সকলে সড়ক ব্যবহার করি। তাই সড়ক ব্যবহারে নিরাপত্তা বা নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের বিষয়টি সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোড ক্র্যাশ একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ – এটি আমাদের সকলকে প্রভাবিত করে। ঢাকা শহরের সড়কগুলো নিরাপদ করতে সড়ক ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সচেতনতা জরুরি। নিরাপদ গতিতে গাড়ি চালানো, জেব্রা ক্রসিং ও সিগানালে গাড়ি থামানো, সিট বেল্ট ব্যবহার, মোটর সাইকেলে হেলমেট ব্যবহারসহ বিদ্যমান আইন ও নীতি মেনে গাড়ি চালানোর বিষয়ে চালকদের সচেতন ও প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। বিশেষ করে, কৌশলগত প্রচারণা কর্মসূচির মাধ্যমে সব পর্যায়ের সড়ক ব্যবহারকারীকে সচেতন করা হলে সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এর সিনিয়র রোড সেফটি স্পেশালিস্ট মোঃ মামুনুর রহমান বলেন, ঢাকায় মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ কমাতে ডিটিসিএ কাজ করছে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হলে পথচারীদের সড়ক পারাপার ও যানবাহনের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক-ঢাকা উত্তর) সুফিয়ান আহমেদ বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী পুলিশকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার আলোকে ডিএমপি কাজ করে যাচ্ছে। সড়ক নিরাপদ করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যানবাহনগুলো যদি আইন মেনে চলে তাহলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

ডব্লিউআরআই’র টেকসই শহর কর্মসূচির পরামর্শক ফারজানা ইসলাম তমা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে নিয়মিত সড়ক দূর্ঘটনার কথা শোনা যায়। কিন্ত নিরাপদ নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে যে এসব দূর্ঘটনার পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের জানা জরুরি। নিরাপদ নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোযোগ দেয়া দরকার। বিআইজিআরএস এর সার্ভিলেন্স কোঅর্ডিনেটর ডা. তানভীর ইবনে আলী বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ভাইটাল স্ট্রাটেজিস, জনহপকিন্স সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ এবং সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও চট্টগ্রাম শহরে রোড ক্র্যাশ, ও সড়ক ব্যবহারকারীদের আচরন (সঠিক হেলমেট ব্যবহার, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ইত্যাদি) বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব তথ্যাবলী সড়ক নিরাপদ করতে নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ন্যাশনাল কনসালটেন্ট (এনসিডি) ডা. ওয়াতিন আলম বলেন, সড়কে কোন ক্র্যাশ হওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্ব অনেক কমানো সম্ভব। এছাড়া রোড ক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় মানুষের সচেতনতা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

অনুষ্ঠানে ঢাকার সড়কে সন্তান হারানো মা, বিএএফ শাহীন স্কুল এন্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রওনাক করিম। তিনি তাঁর ছেলেকে সৌভিক অর্জুন (৪২) নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তিনি তাঁর সন্তানের মৃত্যুর পর ডেথ সার্টিফেকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। সড়কে যারা মারা গেছেন বা যারা মারা যায় সেসব পরিবার যেন প্রশাসনিক সহায়তা পায় সে বেষয়টি আগামী দিনে নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান।

অল্প বয়সে স্বামী হারানো শিক্ষক রেবেকা সুলতানা নীলা তাঁর স্বামী আরিফুল ইসলামের (৪২) ঢাকার সড়কে মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরেন। এ মৃত্যু অবকাঠামোগত হত্যাকান্ড বলে আমি মনে করি। সড়কে ম্যানহোলের গর্ত ছিল, বিপরীত পাশ থেকে রিকশা আসছিল। ট্রাক অতিরিক্ত গতিতে আসছিল – এসব কারণে রোড ক্র্যাশ হয়, যে ক্র্যাশে আমার স্বামী তার মাঝ বয়সে মারা যায়। আমার শিশুসন্তান তার বাবাকে হারায়। হাতিরঝিলে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় মারাত্মক আহত মুসাব্বির হোসেন (৩৮) তার দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, অতিরিক্ত গতির একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। তিনি স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট ব্যবহার করায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। তবে ১৭ ঘন্টা তার জ্ঞান ছিল না। তিনি সকলকে অতিরিক্ত গতি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।

ডিএনসিসি’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম ফুটপাথ ডিজাইন ও নগর পরিকল্পনা বিষয়ে আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করায় ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ও এর অংশীদার সংস্থাসমূহকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আগামী দিনে ঢাকার সড়ককে আরো নিরাপদ করতে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। একইসঙ্গে, তিনি সড়কে স্বজন হারানো সকল পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। তিনি আরো বলেন, যান্ত্রিক যানগুলো জেব্রা ক্রসিং ও সিগনালে সঠিকভাবে থামালে পথচারীদের সড়ক পারাপারে ঝুঁকি কমে আসবে।

অনুষ্ঠানে আরো আলোচনা করেন ডিএনসিসি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, বিআইজিআরএস-এর ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেটর রেজাউর রহমান, ব্র্যাক এর রোড সেফটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক তামান্না মিজান, সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর রোড সেফটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক কাজী বোরহান উদ্দিন, ডিএনসিসি’র নির্বাহী প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং) নাঈম রায়হান খান, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের এডভোকেসি অফিসার মো. মনোয়ারুল ইসলাম, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকল্প কর্মকর্তা মো. জুলহাস আহমেদ, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) এর সিনিয়র প্রজেক্ট ও কমিউনিকেশন অফিসার আবু রায়হান প্রমুখ।

সভায় উপস্থিত শিক্ষক রওনাক করিম-এর সন্তান সৌভিক অর্জুন (৪২) ও রেবেকা সুলতানার স্বামী মো. আরিফুল ইসলাম (৪১) সহ ঢাকা সড়কে রোড ক্র্যাশে নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করার মাধ্যমে গোলটেবিল সভা শেষ হয়।