ঢাকাশনিবার , ৬ জানুয়ারি ২০২৪
  • অন্যান্য

অনলাইন আসক্তি প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
জানুয়ারি ৬, ২০২৪ ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ । ১৯৭ জন

শৈশবকাল হলো মানুষের জীবনের প্রথম স্তর। আর এ শৈশব শব্দটি শুনলে মনের মধ্যে একটি ভালো লাগার অনুভূতি জেগে ওঠে। শিশুরা আমাদের খুব আদরের। অথচ শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যৎ আজ হুমকিতে। ইন্টারনেটের আগ্রাসী ছোঁয়ায় আজ অনেক মানুষ বিপর্যস্ত। তবে এর ভয়াবহতার শিকার প্রধানত অল্প বয়সী শিশু ও কিশোররা।

বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জীবনে গতিময়তা আনা সম্ভব নয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের যেমন ভালো দিক আছে তেমনি তার খারাপ দিকও আছে। তবে এর নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সজাগ থাকা খুবই জরুরি। ইন্টারনেট মানবসভ্যতার একটি বিস্ময়কর অবদান। বর্তমান প্রজন্ম অতিদ্রুত এই প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হচ্ছে। এক দুই যুগ আগেও শিশু কিশোরদের খেলার সঙ্গী ছিল পাড়া প্রতিবেশীদের সন্তান, নানা ধরনের মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল। হরেক রকমের খেলা খেলে পার করত নিজেদের সৌন্দর্যের শৈশব-কৈশোরকাল।

বর্তমানে সময়ে শিশুদের খেলার সঙ্গী কার্টুন, মীনা, গোপাল ভাঁড় প্রভৃতি। শিশু কান্না করলে সান্তনা দেয়ার সহজ পন্থা হলো, বাবু তুমি কান্না করো না, তুমি টিকটক গোপাল ভাঁড়, মীনা রাজু দেখো। শিশুর পড়ার বয়সে আত্মঘাতী অনলাইন জগতে আসক্ত করলে তার মেধা কাজ করবে কোন দিকে? তার পড়ার মেধা তো এই অনলাইনের মাঝে ব্যয় করে। ফলে শিশু একটা সময় অনলাইনে আসক্ত হয়ে যায়, আর পড়তে চায় না। পড়লেও পড়া মনে থাকে না। তার মন মানসিকতা সব সময় অনলাইনের দিকে আসক্ত থাকে। শিশুকাল হলো মানুষের জ্ঞান অর্জনের প্রথম ধাপ। এখান থেকে তার হাতেখড়ি শুরু হবে। তা না হলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতা হারিয়ে যাবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর অনলাইনে আসক্তি হয়ে শিশু-কিশোররা ভবিষ্যতে মেধাশূন্য জাতির পথে অগ্রসর হচ্ছ।

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবাধ তথ্যসম্ভারে বিচরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের চিন্তা, জ্ঞানের পরিধি ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারছে ঠিক। তবে এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন না থাকায় নানা ধরনের বিপদে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে প্রথম ও প্রধান কাজ জ্ঞান চর্চা করা কিন্তু তারা অনলাইনে আসক্ত হয়ে বইয়ের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে। যেখানে শিশু-কিশোররা হবে জ্ঞানপিপাসু, জ্ঞান অন্বেষণের জন্য মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে বেড়াবে, নানা রঙের নানা জ্ঞানের বই পাঠ করে নিজের মস্তিষ্ককে করবে আরও উর্বর, নিজেকে করবেন আরও সমৃদ্ধ। সেখানে তারা মোবাইল ফোনের স্ক্রিন আর ল্যাপটপের মনিটরে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ফেলছে।

দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ইন্টারনেটে নিরাপত্তা নিয়ে শিশুরা কী ভাবে, তাদের পরিস্থিতি কী এসব জানতে ইউনিসেফ সারাদেশে এ জরিপ চালায়। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১১ হাজার ৮২১ ছেলেমেয়ে জরিপে অংশ নেয়। ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওই জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ৮১ দশমিক ২ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাগে মাধ্যমে প্রতিদিন সময় কাটায়। এদের ৯০ শতাংশই মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা কোনো না কোনো ধরনের প্রযুক্তিগত পর্দার সামনে ব্যয় করেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মানুষ আত্মহত্যা করে।

বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থীর একই ব্যক্তির দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হওয়া অথবা অনলাইনে উত্ত্যক্তের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মাদক, অস্ত্র, আত্মহত্যা ও নিজেকে ঘৃণা করা জাতীয় প্রচারণা বাড়লেও সাধারণ স্কুল শিক্ষার্থীরা এগুলোকে খুব একটা হুমকি মনে করে না। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, দেশের ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি বা উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে। আর একাধিকবার হয়রানির শিকার হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। হয়রানি বা উত্ত্যক্তের কারণে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।

ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সতর্ক হতে হবে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা প্রয়োজন। যে কোনো মূল্যে শিশু-কিশোরদের নিরাপদ শৈশব ও কৈশোর নিশ্চিত করতে হবে। তবেই নিশ্চিত করা যাবে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন আসক্তি কমাতে অভিভাবকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানকে বকুনি দিয়ে কিংবা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে এ অভ্যাস ঠেকানো যাবে না। বরং এতে বিপরীত হতে পারে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ আসক্তদের এসব ডিভাইস ব্যবহারের সময়টি ধাপে ধাপে কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সবার আগে অভিভাবককে দেখতে হবে কেন তার সন্তান অনলাইনে বা অনলাইন গেমে সময় কাটানোতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে? শুধু অনলাইন গেম খেলতে কিংবা অনলাইনে থাকতে নিষেধ করলেই হবে না, বিকল্প কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া সন্তানের সামনে অভিভাবকদের স্মার্টফোনে মগ্ন থাকা, খাবার টেবিলে স্মার্টফোন দেখার অভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে।