ঢাকারবিবার , ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩
  • অন্যান্য

উৎসবে আতশবাজি-পটকা ফোটানোর ক্ষতি বহুমাত্রিক

পাবলিক হেলথ ডেস্ক
ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩ ৭:৪৭ অপরাহ্ণ । ৩৪৩ জন

থার্টি ফাস্ট নাইট বা ইংরেজি বর্ষবরণ উদযাপনসহ নানা উৎসবে আতশবাজি-পটকা-ফানুস ব্যবহার করা হয়। এসব আতশবাজি-পটকা পরিবেশসহ মানুষের স্বাস্থ্যকে বহুদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

আতশবাজি পোড়ালে তিন প্রকারের শক্তি উৎপন্ন হয়— শব্দ, আলো এবং তাপ। আতশবাজির বর্ণচ্ছটার পেছনে দায়ী বিভিন্ন রকমের ধাতব লবণ : লিথিয়াম লবণের জন্য গোলাপি রঙ সোডিয়ামের লবণের জন্য হলুদ বা কমলা রঙ, কপার (তামা) এবং ব্যারিয়ামের লবণের জন্য সবুজ বা নীল রঙ হয়ে থাকে। আর স্ট্রন্সিয়ামের লবণ দেয় লাল রঙের আলো। বিভিন্ন রকম আতশবাজিতে যখন আগুন দেওয়া হয় তখন একটি সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ধাতব লবণ এবং কেমিক্যাল এক্সপ্লোসিভ (পটাশিয়াম নাইট্রেট, সালফার) অক্সিজেনের সাথে দহন বিক্রিয়া করে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তির পাশাপাশি উৎপন্ন হয় ধোঁয়া ও কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনের মতো প্রাথমিক কিছু গ্রিন হাউস গ্যাস। আর দহন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন তাপ দ্রুতগতিতে বের হয়ে আসে এবং আশপাশের বাতাসকে শব্দের গতির চাইতেও দ্রুততার সাথে প্রসারিত করে। বাতাসের এই প্রসারণই একটি শক ওয়েভ তৈরি করে, যা আমরা বিকট শব্দ হিসেবে শুনতে পাই। এই শব্দের তীক্ষ্ণতা ১৫০ থেকে ১৭৫ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাজি-পটকা থেকে উৎপন্ন লেড বা সিসার অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় রক্তশূন্যতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসাড়তা প্রভৃতি রোগ হতে পারে। অ্যান্টিমনি দূষণের ফলেও অনেকটা এ রকম হয়ে থাকে।

কার্বন মনো–অক্সাইড গ্যাস বাতাসের মাধ্যমে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তে মিশে যায়। ফলে শরীরের রক্ত পরিবহনে সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যও দায়ী এই গ্যাস। কার্বন মনো–অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে তৈরি করে রেডিক্যাল। ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার জন্য এই রেডিক্যালই দায়ী।

কার্বন ডাই-অক্সাইডের ক্ষতিকর প্রভাব আমরা কমবেশি সবাই জানি। এর ফলে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এতে রক্তের চাপ বেড়ে যায় মস্তিষ্কে। ফলে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এই দুই মৌলের পাশাপাশি আতশবাজিতে আরও ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম ও বেরিয়াম নাইট্রেট। পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের জন্যও এগুলো ক্ষতিকর।

আতশবাজি ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে, সালফার, পটাশিয়াম নাইট্রেট, লেড ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর পিএম ১০ ও ২.৫ কণা থাকে যা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর, ক্যান্সার হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে।’

আর্সেনিক দূষণের ফলে দুরারোগ্য চর্ম রোগ এবং যকৃতের রোগ হতে পারে। শরীরবিদদের মতে, আর্সেনিকের বিষক্রিয়া শরীরের প্রভূতি ক্ষতিসাধন করতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি ধাতু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালানোর জন্য খুবই প্রয়োজন। তবে এর মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীরে দেখা দেয় নানা রকম বিপত্তি। আতশবাজি-পটকা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সাথে এসব পদার্থ প্রথমে ফুসফুসে যায়। তারপর রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। তাই এর ফলে দেহে নানা রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

মানুষের চুলের গড় আকার ৭০ মাইক্রোমিটার হলে পিএম ১০ এর সাত ভাগের এক ভাগ আর পিএম ২.৫ হলো তারও চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ এতোটাই ক্ষুদ্র যে এই কণাটি সহজেই রক্তে প্রবেশ করতে পারে। ফলে ভারী ধাতু সম্বলিত এসব কণা রক্তে প্রবেশ করলে জীবন অনেকটাই ঝুঁকিতে বলা যায়।

চীনের ৩৩৫টি শহরে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় নববর্ষে আতশবাজির ব্যবহারে বাতাসে ক্ষতিকর কণার পরিমাণ ৮৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া বায়ূমান সূচক ও সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে যথাক্রমে ৫৭ শতাংশ ও ৬৯ শতাংশ।

বৃদ্ধ ও শিশুদের ঝুঁকি

সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও বৃদ্ধরা। যারা হার্টের রোগী, যাদের অ্যাজমা আছে কিংবা যাদের স্ট্রোক হয়েছে তাদের জীবন আতশবাজির মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে বুকে ব্যাথাসহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আতশবাজি থেকে নির্গত ধোঁয়া মা ও শিশু উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। আতশবাজি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং পার্টিকুলেট ম্যাটারসহ অনেক বিষাক্ত উপাদান থাকে। গর্ভাবস্থায় মহিলারা এই দূষণের সংস্পর্শে এলে এই বিপজ্জনক গ্যাসগুলি শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি করতে পারে।

আতশবাজির সংস্পর্শে আসার কারণে ত্বকে অ্যালার্জি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আতশবাজির রাসায়নিক পদার্থ ত্বকের মাধ্যমে শরীরে পৌঁছাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, যেকোনো গর্ভবতী নারীর আতশবাজি থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত।

পশুপাখির আতঙ্ক, পরিবেশের ক্ষতি

কুকুর বেড়াল ইত্যাদি প্রাণির শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে বেশি। কুকুর ৬০ হাজার হার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে পায়। যে কারণে আতশবাজি-পটকা ইত্যাদি ফোটানোর ফলে এসব প্রাণি ভয় পায়, এমনকী কারো কারো মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানাস অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার লাল ডানাবিশিষ্ট পাখি মারা যায় থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের জন্য।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানাস অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার লাল ডানাবিশিষ্ট পাখি মারা যায়

ফানুসে ক্ষতি

সম্প্রতি দেশে চালু হয়েছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক লাইনে ফানুস পড়ার কারণে ১ জানুয়ারি ২০২৩ দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রোরেল।

এছাড়া প্রতিবছর দেশের নানা জায়গায় ফানুস ওড়ানো নিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে রাজধানীর মহাখালী, খিলগাঁও ও মিরপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।

দেশের বাইরে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের বড়সর দুর্ঘটনার নজির আছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের একটি প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে ফানুস থেকে আগুন লেগে যায়। সে আগুন নেভাতে ২০০ জন অগ্নিনির্বাপককর্মীর সময় লেগেছিল ৩ দিন। ২০২১ সালে জার্মানিতে ফানুস থেকে আগুন লেগে একটি চিড়িয়াখানার অনেক পশু মারা গিয়েছিল। সুতরাং এ ধরনের বড় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সবসময়ই থাকে।

আগুন-দুর্ঘটনায় কোটি টাকার ক্ষতি

বাংলাদেশে প্রতি বছর পটকা-আতশবাজি থেকে বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগা ও নানা দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২২ সালের থার্টি ফাস্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানোর কারণে প্রায় ১০০টি স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়।

আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানো থেকে ২০২১ সালে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয় এবং আতশবাজির উচ্চশব্দে তানজিম উমায়ের ওরফে মাহমুদুল হাসান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়।

২০২০ সালে ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৭২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং ২০১৮ সালে ৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৫৬ লাখ ৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সবমিলিয়ে ৫ বছরে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এসব অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকার সম্পদ উদ্ধার করেছে।