ঢাকামঙ্গলবার , ২৫ জুন ২০২৪
  • অন্যান্য

ছড়িয়ে পড়ছে রাসেলস ভাইপার, অ্যান্টিভেনম নিয়ে নেই সুখবর!

নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ২৫, ২০২৪ ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ । ১০৩ জন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা সত্ত্বেও দেশে এখনো আলোর মুখ দেখেনি দেশীয় সাপের বিষ দিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়া। সাপে কাটা রোগীর একমাত্র অবলম্বন ভারতীয় অ্যান্টিভেনম দেশে শতভাগ কার্যকরী নয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরনির্ভরতা থেকে সরে আসতে না পারলে ঝরে পড়বে অনেক মূল্যবান জীবন। দেশেব্যাপী রাসেলস ভাইপার ছড়িয়ে পড়ার এমন বাস্তবতায়, দেশেই দ্রুত অ্যান্টিভেনম প্রস্তুতের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে মহামূল্যবান এই ওষুধ সরবরাহের পরামর্শ তাদের।

‘মাঠে কাজ করার এক পর্যায়ে হঠাৎই কিছু একটার অস্তিত্ব টের পেলেন কৃষক। ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগে পায়ে অনুভব করেন সাপের ছোবল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় বিষক্রিয়ার লক্ষণ। স্বজনদের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লে বিষ নামাতে নিয়ে যাওয়া হয় ওঝার কাছে। চলে দীর্ঘ সময় ধরে ঝাড়ফুঁক। এতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে নিয়ে যাওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ততোক্ষণে পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। চোখের সামনেই নিভে যায় প্রাণ প্রদীপ।’

দেশে অধিকাংশ সর্পদংশনের শিকার হওয়া রোগীর ভাগ্যেই ঘটে এমন করুণ পরিণতি। একটি গবেষণা বলছে, সর্পদংশনের পর ৮০ শতাংশ মানুষ যান ওঝার কাছে। আর ২০ শতাংশকে নেয়া হয় হাসপাতালে। যারা আগে ওঝার কাছে যান, তাদের মধ্যেই মারা যাওয়ার হার বেশি।

প্রশ্ন হলো আধুনিক এই যুগেও মানুষ কেন ওঝার কাছে যায়? ওঝা কি শুধুই ঝাকফুঁক করে নাকি প্রভাবিত করে মানুষের চিন্তার জগতকেও?

এক ওঝা বলেন, ‘কী সাপে কামড় দিয়েছে, সেটা বুঝতে পারি। এ ছাড়া তার শরীরে বিষ দিয়েছে কিনা, সেটাও বুঝতে পারি। তখন সেই হিসেব করেই চিকিৎসা করি। মন্ত্র দিয়ে মানুষজনকে সিগারেট খাওয়ালে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। সাপ কারও হাতে কামড় দিলে হাতে বাঁধন দিতে হবে। কিন্তু মাথা বা ঘড়ে কামড়ালে ২ হাত ও এক পা বাঁধতে হবে। বাঁধার পর রোগী দুদিন পর আসলেও বাঁচানো সম্ভব।

তবে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আবু সাঈদ বলেন, সর্পদংশনের ৮০ শতাংশই নির্বিষ সাপ। ওঝারা ওই নির্বিষ সাপের ওপরই তাদের কেরামতি দেখান! এসব রোগী তাদের কাছে গেলে, তারা তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে, বিভিন্ন গাছগাছালি খাইয়ে বা রক্ত বের করে বিষ নামানোর চেষ্টা করেন। তখন তারা কৃতিত্ব দাবি করেন। কিন্তু সেখানে তাদের কোনো কৃতিত্ব নেই। এটি অপরাধমূলক কাজ। এ ধরনের অপরাধের কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তারা যেন ভণ্ডামি করতে না পারে, সেই বিষয়ে প্রচার চালিয়ে মানুষকে সচেতন করা উচিত।

‘শক্ত বাঁধন দিয়ে বিষ আটকানো যায় না। সর্পদংশন করলে বিষ বিভিন্ন শিরা-উপশিরা দিয়ে ধীরে ধীরে সারা শরীরে প্রবেশ করে। আর বাঁধন দেয়ার পর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে এক পর্যায়ে হা-পা কেটে ফেলতে হতে পারে। সুতরাং বাঁধ না দিয়ে রোগীকে শান্ত রাখতে হবে। হাত-পা নাড়ানো যাবে না’, যোগ করেন এই বিশেষজ্ঞ।

সর্পদংশিত রোগীর মৃত্যুর পেছনে মানুষের অসচেতনতা ও কুসংস্কার যেমন দায়ী, ঠিক তেমনি অনেকেরই অভিযোগ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম না পাওয়ার। আবার অ্যান্টিভেনম থাকলেও অনেক সময় চিকিৎসক ঝুঁকি ভেবে প্রয়োগ করেন না, আছে এমন অভিযোগও। আবার অনেক হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম থাকলেও নেই রোগীর জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা।

সাধারণের এই অভিযোগের বাইরেও দেশে সব চেয়ে বড় সংকট নিজস্ব সাপের বিষ দিয়ে আজও অ্যান্টিভেনম প্রস্তুত করতে না পারার ব্যর্থতা। বর্তমানে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম দক্ষিণ ভারতের সাপের বিষ দিয়ে তৈরি বিধায় দেশীয় সাপের বিষ নিষ্ক্রিয়তায় শতভাগ কার্যকর নয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ শুরু করলেও তা এখনো দেখেনি আলোর মুখ।

বাংলাদেশ টক্সোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, ভারত যে অ্যান্টিভেনম তৈরি করে, সেটি পশ্চিমবঙ্গের সাপের বিষের জন্য নয়। এটি তৈরি হচ্ছে দেশটির দক্ষিণ অংশে। সেখানকার সাপ আর পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সাপ এক নয়। আমাদের হাতের কাছে আর কোনো কিছু নেই। তাই আমরা পাশের দেশ থেকে অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করছি। এটাকে বলা হয়, কাছাকাছি কিছু কাজ করা। এটাকে প্যারাস্পেসিফিক বলে। আমাদের সাপের জন্য এটা স্পেসিফিক না। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এখনো অ্যান্টিভেনম বানাতে পারিনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, অ্যান্টিভেনম দেশে তৈরি করার কাজ চলছে চট্টগ্রামে। গবেষণা এবং উন্নয়ন একটা উচ্চ প্রযুক্তির বিষয়। এটা দীর্ঘ সময় লাগে। তবে আমরা চেষ্টা করছি। সর্পদংশনের পর শরীরে বিষের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে ১০ ভায়েল অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে হয়। ১০টি ভায়ালে একটি ডোজ। ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক ডোজও দিতে হতে পারে।

দেশে প্রতি বছর সর্পদংশনের শিকার হন চার লাখ মানুষ, যাদের মধ্যে মারা যান অন্তত সাড়ে সাত হাজার। এক্ষেত্রে এগিয়ে খুলনা বিভাগ। বিভাগটিতে প্রতি ১ লাখে ৬১৬ জনকে সর্পদংশন করে। এর পরের অবস্থানে বরিশাল বিভাগ। মানুষ ছাড়াও দেশে প্রতি বছর আড়াই হাজার গবাদি পশু ৫৫ হাজারের মতো হাঁস-মুরগি সর্পদংশনে মারা যায়।