ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বাড়েলেও এ নিয়ে আমাদের সচেতনতা যথেষ্ট কম। এই কম-সচেতনতার একটা দিক হলো ডায়াবেটিস নিয়ে আমাদের ভুল জানা বা অজ্ঞতা। এসব ভুল ধারণা আমাদের জন্যে বিপদ বয়ে আনতে পারে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে—
- ডায়াবেটিস হলো বংশগত
অনেকেই মনে করেন, ডায়াবেটিস একটি জেনেটিক্যাল বা বংশগত রোগ। যাদের বংশে কারো ডায়াবেটিস নেই, তাদের ডায়াবেটিস হবে না। এটা একেবারেই ভুল ধারণা। ডায়াবেটিস বংশগত, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে বংশের কারো ডায়াবেটিস না থাকলেও ডায়াবেটিস হতে পারে। এটা হতে পারে নানা কারণেই।
- বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়
আমরা অনেকেই মনে করি যে যারা মিষ্টি বা চিনি-জাতীয় খাবার বেশি খায়, তাদেরই শুধু ডায়াবেটিস হয়। সরাসরি মিষ্টি খাওয়ার সঙ্গে ডায়াবেটিস হওয়ার কোনো যোগসূত্র নেই। মিষ্টি বেশি না খেলেও ডায়াবেটিস হতে পারে। মিষ্টি দ্রব্যে ক্যালরি বেশি আর এ কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কিছুটা বাড়ে।
বর্তমান যুগের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিবেচনা করলে আমাদের প্রত্যেকেরই কম বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকি আছে।
- ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়া যায় না
ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দিলে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় সব ধরনের খাবারই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্তরাও মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে পারেন, তবে তা নিজেদের মনমতো নয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো।
- অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হয় না
অনেকের ধারণা যে ডায়াবেটিস শুধু বৃদ্ধ বয়সে হয়। কিন্তু ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে ২০-৪০ বছর বয়সীরা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকী শিশুদেরও ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে।
- মোটা মানুষেেই ডায়াবেটিস হয়
কেউ কেউ মনে করেন, কেবল মোটা মানুষদেরই ডায়াবেটিস হয়। এটাও একেবারেই ভুল ধারণা। মোটা বা অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলাকায় মানুষের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি থাকে। কিন্তু রোগা-পাতলা বা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের মানুষেরও ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ভিত্তিই হলো ওজন নিয়ন্ত্রণ।
- ডায়াবেটিস হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়
অনেকে ঘন ঘন প্রস্রাবকেই ডায়াবেটিসের একমাত্র লক্ষণ বলে মনে করেন। এখানে দু্ই ধরনের ভুল হয়ে থাকে। ঘন ঘন প্রস্রাবের লক্ষণ ছাড়াও ডায়াবেটিসের আরো বহু লক্ষণ আছে। এমনকী কোনো ধরনের দৃশ্যমান লক্ষণ ছাড়াও ডায়াবিটস হতে পারে। আবার ডায়াবেটিস ছাড়া আরো বহু কারণেই ঘন ঘন প্রসাব হতে পারে।
- ডায়বেটিস শরীরকে দুর্বল করে দেয়
অনেকেই মনে করেন যে ডায়াবেটিস শরীরকে দুর্বল করে দেয়। এটাও একটা ভুল ধারণা। তবে দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসা না করলে শরীরে এই ধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে।
- দীর্ঘদিন ওষুধ খেলেই ডায়াবেটিস সেরে যায়
ডায়াবেটিক আক্রান্ত ব্যক্তিকে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতেই হবে। কিছুদিন ওষুধ খেয়ে সুগারের পরিমাণ একটু নিয়ন্ত্রণে এসে গেলেই রোগ সেরে গিয়েছে ভেবে অনেকেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। আর এতেই বিপদ বাড়ে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা চলবে না।
- ডায়াবেটিস হলে সবসময় ওষুধ খেতে হবে
এই ধারণা সঠিক নয়। ওষুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে বহুমুখী পদ্ধতির অংশ মাত্র। ওষুধ একমাত্র সমাধান নয়। ডায়েট, ব্যায়াম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখলে সুস্থ থাকা সম্ভব।
- একবার ইনসুলিন নিলে সারাজীবন নিতে হবে
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কারো কারো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইনসুলিন প্রয়োজন হয়। এটি নির্ভরতা নয় বরং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং জটিলতা প্রতিরোধের জন্য জরুরি। একবার ইনসুলিন ইনজেকশন গ্রহণ করলে আজীবন গ্রহণ করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়।
- ডায়াবেটিস হলে সবাইকে একই নিয়মে চলতে হবে
ব্যক্তি ভেদে ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা ভিন্ন। বয়স, ডায়াবেটিসের ধরন, জীবনযাত্রা এবং অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে চিকিৎসক ঠিক করে দেবেন চিকিৎসা পদ্ধতি।
- ডায়াবেটিস মানেই আজীবনের অসুস্থতা
এটি একেবারেই ভুল ধারণা। ডায়াবেটিস রোগী তার খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এবং জীবনধারার শৃঙ্খলা এনে পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় জীবনযাপন করতে পারেন।
- দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের ওষুধ খেলে কিডনি নষ্ট হয়
অনেকে মনে করেন যে দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের ওষুধ খেলে কিডনি বা বৃক্ক নষ্ট হয়ে যায়। এমন যে হয় না, তা নয়। আর সে কারণেই রক্ত পরীক্ষার ফলাফল দেখে চিকিৎসক যে ব্যবস্থাপত্র দেন তা অনুসরণ করা খুব জরুরি। রক্ত পরীক্ষার ফল স্বাভাবিক আসলে অসংখ্য ডায়াবেটিস রোগী ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এমনটি মোটেও ঠিক নয়। এতে ডায়াবেটিস আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।
- ডায়াবেটিস রোগীরা কার্বোহাইড্রেট খেতে পারেন না
অনেকে মনে করেন যে ডায়াবেটিস রোগীরা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেতে পারবে না। এই ধারণাটিও সঠিক নয়। কার্বোহাইড্রেটের বাংলা নাম শর্করা বা শ্বেতসার। কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করাকে প্রভাবিত করে, তবে এটি সুষম খাদ্যের অপরিহার্য অংশ। পরিমিত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট খেলে কোনো ক্ষতি নেই। বেশি আঁশযুক্ত ফল ও শাকসবজি জাতীয় খাবার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ভালো। তবে প্রতিদিন কী পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত, তা ঠিক করতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ লাগবে।
- ফল খাওয়া যাবে না
ডায়াবেটিস রোগীরা ফল খেতে পারেন না, এমনটা অনেকের ধারণা। কিন্তু ধারণাটা ভুল। ফল স্বাস্থ্যকর খাদ্য, এতে আঁশ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে। কিন্তু যেহেতু ফলে শর্করাও থাকে, সুতরাং ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র মানতে হবে।
- বিশেষ খাদ্যাভ্যাস মানতে হবে?
ডায়াবেটিস হলেই মানতে হবে বিশেষ খাদ্যাভ্যাস— এটা ঠিক নয়। বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগীর কোনো বিশেষ খাদ্যাভ্যাসের প্রয়োজন নেই। একজন সুস্থ মানুষের সুস্থতা ধরে রাখার জন্য যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস কিংবা জীবনযাত্রা মেনে চলা উচিত, সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও সেটাই যথেষ্ট। তবে এটা নির্ধারণ করবে রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসের পর্যবেক্ষণ।
ডায়াবেটিস হলে পছন্দের সব খাবার পরিহার করতে হবে এটিও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা পছন্দের খাবার অবশ্যই খেতে পারবেন, তবে তা তৈরিতে সামান্য পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন খাবারে তেলের পরিমাণ কমিয়ে আনা।
- ইনসুলিন কি শেষ চিকিৎসা?
ইনসুলিন ডায়াবেটিসের একটি সাধারণ চিকিৎসা, এটি একেবারে শেষ পর্যায়ের চিকিৎসা নয়। তাই ইনসুলিন দেওয়া হচ্ছে মানেই রোগীর অবস্থা খুব জটিল, এমন ভাবার কারণ নেই। ইনসুলিন একজন ডায়াবেটিস রোগীর জীবনে যেকোনো সময়েই লাগতে পারে। টাইপ-২-সহ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে ইনসুলিন নিতে পারেন।
- ডায়াবেটিসকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই
কেউ কেউ মনে করেন যে ডায়াবেটিস হলে তেমন গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। শুধু ইনসুলিন নিলেই চলবে। এটাও ভুল ধারণা। ডায়াবেটিসের ধরন, আক্রান্তের বয়স, অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে।